আজ ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে বিশ্ব

(আজকের দিনকাল):ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর গত নয় মাসে বিশ্বব্যাপী নতুন সংকট দেখা দিয়েছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেনেট ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক পলিসি এ বিষয়ে যুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে বিশ্বের মানুষের মতামত নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

এতে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে তেমন অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ এ সংঘাত পূর্ব এশিয়ার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ এবং ইউরোপের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের মানুষের মনোভাবকে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে আরও বদলে দিয়েছে। বলতে গেলে, আরও আমেরিকামুখী করেছে।

কিন্তু গণতান্ত্রিক এ ব্লকের বাইরে এ প্রবণতা কিন্তু একেবারেই আলাদা। এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধের এক দশক আগেও ইউরেশিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকার উত্তর ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত দেশগুলোয় এ জনমত পশ্চিমাদের পক্ষে যাই থাকুক না কেন, যুদ্ধ শুরুর পর তা রাশিয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকছে।

একইভাবে ইউরোপ, অ্যাংলো-আমেরিকান পরিমণ্ডলের দেশগুলো (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র) এবং জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলো করোনা মহামারির আগেও চীনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। তবে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার সাব-সাহারা এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলো চীনের প্রতি অনেক বেশি অনুকূলে বলে মনে করা হয়েছিল।

পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়ানোর পর এ প্রবণতায় পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২ সালেও রাশিয়ার জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমেই নেমে যাচ্ছিল। কিন্তু রুশ আগ্রাসনের পর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনমত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়ার পাল্লাকেই কিছুটা ভারী করেছে এবং প্রথমবারের মতো একই প্রবণতা চীনের পক্ষেও দেখা যাচ্ছে।

গত কয়েক মাস ধরেই ভূ-রাজনৈতিক এ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অ্যাংলো-আমেরিকান পরিমণ্ডল এবং ইউরোপের বাইরেও রাশিয়ার অর্থনীতি পৃথকীকরণের যে চেষ্টা ছিল, তা সামান্য হলেও সমর্থন জুগিয়েছে। একইভাবে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টাও।

আফ্রিকাজুড়েই রুশ সামরিক বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। মস্কো এখন এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত জ্বালানি কিনতে আগ্রহী ক্রেতাও খুঁজে পাচ্ছে। সিরিয়ায় নিজেদের অবস্থান স্থিতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র কুর্দিদের পাশ কাটিয়ে সম্প্রতি সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে একটি শান্তি সম্মেলনও আহ্বান করেছে পুতিন সরকার। মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের ফাঁস হওয়া নথি থেকে এমন ইঙ্গিতও মিলেছে যে, মার্কিন মিত্র ও মদদপুষ্ট হিসাবে অবস্থান থাকা সত্ত্বেও মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে গোপনে অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন।

সব মিলে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের সাম্প্রতিক এক জরিপে প্রকাশ পেয়েছে, পশ্চিমা জোটের বাইরের দেশগুলোর ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন ধীরে হলেও কমছে। গেল বছর আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার প্রতি যেভাবে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছিল, তা আর দেখা যাচ্ছে না। উলটো রুশ সমর্থক ও নিরপেক্ষ দেশের সংখ্যাই বাড়ছে। এজন্য মস্কোর মিত্র দেশ হিসাবে পরিচিত চীনের বেশ বড় ভূমিকা আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসাবে পরিচিত সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় মধ্যস্থতার উদ্যোগ রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন অবস্থান থেকে সরিয়ে আনছে।

এটা পরিষ্কার নয় যে, এ বাস্তবতা অনুধাবন করে বাইডেন প্রশাসনের কাছে কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। অবশ্য ভূ-রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভক্তি, উদারনীতি ও কর্তৃত্ববাদের কথা বলে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির বেশকিছু উদ্যোগ ঠেকিয়েছে হোয়াইট হাউস। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতন্ত্রবিষয়ক এক শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটোভুক্ত দুই দেশ তুরস্ক ও হাঙ্গেরিকে যোগদান থেকে বিরত রেখেছিল। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, দেশ দুটি গণতন্ত্রায়ণে এতটাই পিছিয়ে পড়েছে যে, তাদের এ সম্মেলনে অংশ নিতে দেওয়া যায় না।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ওয়াল্টার রাসেল মিড উল্লেখ করেছেন, এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান আন্তর্জাতিক বাস্তবতা কোথায় দাঁড়িয়েছে। এটি বাইডেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বার্তার সঙ্গেও খাপ খায়, যা তাদের ‘উদার গণতন্ত্রের জন্য বৈশ্বিক লড়াই’ এবং ‘পপুলিস্ট জিওপির (রিপাবলিকান পার্টি) বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম’ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু মিড যখন বিষয়টি নিয়ে তর্কে যান, দেখা যায় এ গণতন্ত্রের সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গিটি কৌশলগতভাবে নিজেদেরই পরাজিত করার ঝুঁকিতে ফেলছে। মিড বলেন, এর বাইরে, আপনি কেবল চীন বা রাশিয়াকে নিয়ে প্রয়োজনীয় কোনো জোট তৈরি করতে পারবেন না। যদি অ্যাংলো-আমেরিকান উদারনীতি বা ইউরোক্র্যাট পদ্ধতিবাদকে না জড়িয়ে হয়, তবে আপনি এমন দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না। শুধু রাজতন্ত্র ও সামরিক শাসকদের সঙ্গেই নয়, জনতাবাদ এবং উদার গণতন্ত্র বা উদার কর্তৃত্ববাদের মতো রাজনৈতিক মডেলকেও গঠনমূলকভাবে মোকাবিলা করার জন্য আপনার একটি উপায় প্রয়োজন। অনেকটা ভারতের নরেন্দ্র মোদি এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের মতো। যদি না আপনি চান পুরো বিশ্ব মস্কোর মতো কঠোর কর্তৃত্ববাদ কিংবা বেইজিংয়ের সর্বগ্রাসী প্রযুক্তিবাদের অধীনে যাক।

একইভাবে আপনি যদি বাড়িতেও এ গণতান্ত্রিক কৌশল নিয়ে আপনার ঘরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে ক্রমাগত বিরোধে জড়িয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রেও টেকসই দ্বিপাক্ষিক সমর্থন লাভ করতে পারবেন না। অথবা যদি বিষয়টি শুধু আপনার নিজস্ব রাজনৈতিক জোটের গুরুত্ব বাড়াতেও করে থাকেন, তাহলেও না। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ কৌশল কখনোই সামাজিক উদারতাবাদ কিংবা প্রগতিবাদের মতো টেকসই হবে না। এবং এটি সবসময়ই পরবর্তী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই চক্রের কাছে জিম্মি থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বোঝার জন্যও এ শেষ পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু উদারপন্থি পর্যবেক্ষক মনে করতেই পারেন যে, এ চ্যালেঞ্জ মূলত অনিচ্ছাকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া শাসনের চ্যালেঞ্জ-রাশিয়া ও চীনের মতো যে অনুদার ব্যবস্থা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার শাসকরা অনুকরণ করতে চায়। কিন্তু যদি সেসব দেশের জনগণের ঘাড়ের ওপর থেকে বুট সরে যায়, তবে তারা কিন্তু সেই উদার শিবিরেই ফিরে আসবে।

এ বিষয়ে বেনেট ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। এখানে অ-পশ্চিমা জনমত যে শুধু চীন ও রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে তাই দেখানো হয়নি, এটি প্রমাণও করছে যে, মৌলিক মূল্যবোধের ভিন্নতা শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা স্বার্থের জন্যই নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য এ উন্নত গণতন্ত্র বিভক্তির দিকেও নিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে গেল ৩০ বছরে গোটা বিশ্বে সামাজিক মূল্যবোধের একটি সূচক দেখানো হয়েছে, যা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। সূচকটি মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিবাদ, যৌনতা এবং মাদক সম্পর্কে প্রগতিশীলদের ধারণা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিমাপ নিয়ে করা। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বার্লিন প্রাচীর পতনের পর থেকে উচ্চ আয়ের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ক্রমেই আরও উদার হয়ে উঠছে। কিন্তু বিশ্বের বাকি অংশে এ মূল্যবোধ খুব কমই বদলেছে।

বর্তমান প্রগতিশীল মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি তাই যে কারও জন্যই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিনের উদার সাম্রাজ্যের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আপনি হয়তো খুব কাছের মিত্রদের একত্রিত করতে পারেন, কিন্তু এর মাধ্যমে আপনি সবাইকে একঘরে করার ঝুঁকিও তৈরি করছেন।

 

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস

 

রস ডাউথ্যাট : মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ