(আজকের দিনকাল):ধান উৎপাদনে সর্বাধিক উৎপাদনশীল মৌসুম বোরো। এ কথা অনস্বীকার্য, বোরোর ওপর ভিত্তি করেই দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। কারণ দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৮ শতাংশ আসে এ মৌসুম থেকে। তাই গ্রাম-বাংলার প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে এখন বোরোকেন্দ্রিক ব্যস্ততা। পাকা ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা, ঘরে তোলাসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পারে করছেন কিষান-কিষানিরা।
সকাল থেকেই জমিতে ছুটছেন কৃষক, বাড়িতে গৃহিণীরা ব্যস্ত উঠান পরিষ্কার করে ধান রাখা, মাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা ও সংরক্ষণের কাজে। এ যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ! উঠান বা আঙিনাজুড়ে শুধু ধান আর ধান। কারও বাড়ির উঠান টইটম্বুর হয়ে গেছে সোনালি ধানে। পাকা ধানের ঘ্রাণে ম ম করছে চারদিক। রাশি রাশি সোনালি ধান সংরক্ষণে কেউ গাছের ছায়ায় বসে ধান তোলার কাজে ব্যবহার্য পুরোনো ধামা, পইয়া, তাফাল, গোলা ঠিক করছেন। বোরো ফলনের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ লাখ ৭৬ হেক্টর আর আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল। মাঠে কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্ত ব্লাস্ট আক্রমণ ছাড়া কালবৈশাখি ও শিলাবৃষ্টি কম হওয়ায় এবার বোরো ধানের ফলনের অবস্থা বেশ ভালো ছিল, হাওড়ের ধানও নির্বিঘ্নে শতভাগ কৃষকের ঘরে উঠেছে।
ফলে আশা করা হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বোরের উৎপাদন ১০ লাখ টন বেশি হবে। শুধু হাওড়ভুক্ত সাত জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওড়ে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর এ সাত জেলায় হাওড় ও হাওড়ের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে, যেখানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। ধান কাটার পর বিঘাপ্রতি গড় উৎপাদনের ধারা দেখে সবাই বলছেন, এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
এতদিন ধরে বোরোর সেরা জাত ছিল ব্রি উদ্ভাবিত ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯। ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত এ দুটি বোরো জাত দেশের মোট বোরো এলাকার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করে ছিল। অনেক বিকল্প জাত উদ্ভাবিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে বোরো আবাদে কৃষকের বড় একটি অংশের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জাত ছিল ব্রি ধান-২৮ ও ২৯। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আবাদ হওয়া এ জাত দুটির রোগবালাই সহনশীলতা ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তা আবাদে নিরুৎসাহিত করে আসছিলেন।
পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত বিকল্প জাত ব্রি ধান-৮৮, ৮৯, ৯২, ৯৬ ও বঙ্গবন্ধু ধান-১০০সহ কয়েকটি জাত চাষ করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। রোগবালাই সহনশীল ও উচ্চ ফলনের কারণে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর প্রতি কৃষকের আস্থা ক্রমেই বেড়েছে। এবার মাঠে কৃষকের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে এ পাঁচটি বোরোর জাত। কৃষক বলছেন, এ জাতগুলোর ফলন আশাতীত ও অভাবনীয়।
কৃষকের বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত নতুন এসব জাত। এবার এলাকাভেদে নতুন জাতগুলোর গড় ফলন ছিল বিঘাপ্রতি ২৮-৩৩ মন। কোথাও কোথাও আরও বেশি ফলনের রেকর্ড রয়েছে। এতদিনের কাঙ্ক্ষিত সেই বিকল্প জাত এখন কৃষকের হাতে হাতে। এসব জাতের কয়েকটি মাঠ দিবসে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সরাসরি কথা হয় অনেক উচ্ছ্বসিত কৃষকের সঙ্গে। সহকর্মী বিজ্ঞানীরা গিয়েছিলেন ফসল কর্তন অনুষ্ঠানে। আমার নিজের এবং সহকর্মীদের সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।
গত ৩০ এপ্রিল কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামে দুটি স্থানে মাঠ দিবস ও ফসল কর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। উপজেলায় ৪৮ জন কৃষকের ১৫০ বিঘা যৌথ জমিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে। কথা হয় যৌথ চাষাবাদের কৃষক দুলহাস শেখের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘আগে আমাদের এখানে ৩৩ শতাংশের বিঘায় যেখানে ১৮ থেকে ২০ মন ধান পাওয়া যেত, এখন সেখানে আমাদের ধান গবেষণা উদ্ভাবিত ধান (ব্রি ধান-৮৯, ব্রি ধান-৯২, ব্রি ধান-৯৯ এবং বঙ্গবন্ধু ধান-১০০) চাষ করে বিঘায় ৩৩ মনেরও বেশি ধান ফলন হচ্ছে এবং এর ফলে আমি ও আমার প্রতিবেশী কৃষক খুশি।
একটা সময় পরিশ্রম বেশি হওয়ায় ধান চাষে কৃষকের অনীহা দেখা যেত, কিন্তু এখন সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও প্রণোদনা সহায়তার কারণে কৃষক পতিত জমিতে ধান চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে। নতুন জাতের ধানের ফলন ভালো হওয়ায় বেশ লাভবান হচ্ছে।’ টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমরিয়া গ্রামের কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু ধান-১০০এর বীজ ও সার বিনামূল্যে পাই। দারুণ ফলন পেয়েছি। বিঘায় প্রায় ৩০ মন। এ জাতের ধানে রোগবালাই নেই। ভবিষ্যতে আমি এ ধানের চাষ আরও বাড়াব।’
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে গোপালগঞ্জ জেলার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৬ হেক্টর, মুকসুদপুরে ৩৫ হেক্টর, কাশিয়ানীতে ১৮ হেক্টর, কোটালীপাড়ায় ১৯০ হেক্টর ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ১৯৬ হেক্টরে নতুন এ ধানের চাষ হয়েছে। কোটালীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় বলেন, ‘কোটালীপাড়া উপজেলায় বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ কাটা শুরু হয়েছে। আমরা নমুনা ফসল কেটে দেখেছি প্রতি হেক্টরে এ ধানের ফলন হয়েছে সাড়ে ৭ টন। জিংক সমৃদ্ধ এ ধানের বাম্পার ফলনে কৃষক এ জাতের ধানের চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।’
গত ২ মে গিয়েছিলাম গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার ধনপুর গ্রামে ব্রি উদ্ভাবিত এসব নতুন জাতের মাঠ দিবস অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের ফাঁকে কথা হয় কৃষক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এ বছর ব্রি ধান-২৮ ও ২৯-এর পরিবর্তে ব্রি ধান-৮৯, ৯২ ও বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ আবাদ করেছেন পাঁচ বিঘা জমিতে। কৃষক মুজিবুর জানান, ‘পাঁচ বিঘা জমিতে আমি এসব ধান চাষ করে আগের চেয়ে প্রতি বিঘায় অন্তত ১০-১২ মন বেশি ফলন পেয়েছি। তাছাড়া খরচও লেগেছে অনেক কম।’
জেলার মুক্তারপুর ইউনিয়নের বৃদ্ধ কৃষক আলম মিয়া বলেন, ‘আমার বয়সে এ জাতের মতো ফলন আর কোনো জাতে পাইনি। বাম্পার ফলন হয়েছে ব্রি ধান-৮৯, ৯২ ও বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ জাতে। এ জাতের চাল চিকন। বাজারে ভালো দাম পাব বলে আশা করছি। এ তিন জাতের ধান চাষে পানিও কম লাগে, কীটনাশক লাগে না বললেই চলে।’
কালীগঞ্জ উপজেলার ধনপুর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আলতাফ হোসেন প্রবাসে থাকতেন। তিনি জানালেন, ‘ধানের নতুন জাত ব্রি ধান-৯২ চাষ করে প্রতি বিঘায় ফলন পেয়েছি ৩৩ মন, যা কল্পনাতীত। এ জাতের ধান চাষে পানি কম লাগে, কীটনাশক লাগে না বললেই চলে। তিনি বলেন, ‘আগে বিদেশে ছিলাম। কৃষিকাজ করতে আগ্রহবোধ করতাম না। ভাবতাম কৃষির চেয়ে প্রবাসে চাকরিই অলাভজনক। কিন্তু ব্রি ধানের নতুন জাত আমার ধারণা বদলে দিয়েছে। আর বিদেশ নয়, দেশেই কৃষিকাজ করব।’
বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে বিঘাপ্রতি সাড়ে ২৮ মন ফলন দিয়েছে ব্রি ধান-৯২। লাভজনক হওয়ায় খরাসহিষ্ণু ও পানিসাশ্রয়ী এ জাতের ধান জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ অঞ্চলে। চলতি বোরো মৌসুমে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধোকড়াকুল এলাকায় ১১০ বিঘা জমিতে চাষ হয়েছে উচ্চফলনশীল এ ধান। আর এ উদ্যোগে সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) রাজশাহী আঞ্চলিক অফিস।
গত ৪ মে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের কাজীগ্রামে ব্রির রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগের আয়োজনে কৃষকের মাঠে কৃষকের ফসল কর্তন ও মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করি, যেখানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন এমপি। মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করে স্থানীয় কৃষক আরিফুর রহমান, গোলাম মোস্তফা ও হারুনুর রশীদ। এর মধ্যে কৃষক আরিফুর রহমান ব্রি ধান-৮৯, গোলাম মোস্তফা ব্রি ধান-৯২ এবং হারুনুর রশীদ ব্রি ধান-৮৯, ৯২ ও বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ চাষ করেছেন। এ তিন চাষিসহ কাজীগ্রামের প্রত্যেক কৃষক এবার এ জাতগুলো চাষ করে বিঘায় ৩০ মনের বেশি ফলন পেয়েছেন।
বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের চরগাছিয়া গ্রামের একটি মাঠে ২০০ বিঘা জমি এবার প্রথমবারের মতো বোরো চাষের আওতায় এসেছে; আগের বছরগুলোতে এ সময়ে জমিগুলো পতিত থাকত। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্যোগে এবং উপকূলীয় শস্য নিবিড়করণ কর্মসূচির আওতায় ওই ২০০ বিঘা (২৭ হেক্টর) জমিতে ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৯, ব্রি ধান-৯২, ব্রি ধান-৯৭ ও ব্রি ধান-৯৯ চাষ করা হয়। ৩০০ জন কৃষককে বীজ, সেচ, সারসহ সব উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ফলে এ বছর মাঠজুড়ে চাষ করা হয়েছে ব্রি ধান-৬৭, ৭৪, ৮৯, ৯২, ৯৯ ও বঙ্গবন্ধু ধান-১০০। নমুনা শস্য কাটায় রেকর্ড ফলন পাওয়া যায়। যেখানে প্রতি বিঘায় ব্রি ধান-৮৯এর ফলন হয়েছে ৩৭ মন এবং ব্রি ধান-৯২ হয়েছে বিঘায় ৩৩ মন। এছাড়া ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৭৪ ও ব্রি ধান-৯৯ হয়েছে প্রতি বিঘায় ২৮ মন করে।
প্রায় ৫০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ আবাদকারী দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক মতিউর রহমান জানান, অন্যান্য ধানের তুলনায় এ ধানের ফলন ভালো। পাশাপাশি এ ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড় আক্রমণ রোধ করার ক্ষমতা থাকায় উৎপাদন খরচও কম হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতি একর জমিতে এ ধানের ফলন হয়েছে ৮৫ মন, যা অন্যান্য ধানের তুলনায় বেশি। কম সময়ে ভালো ফলন ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এ ধান আবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন অন্য কৃষকও। ইতোমধ্যেই তার কাছে অনেকে কৃষক বীজ চাইতে আসছেন।
কৃষিবিদ এম আবদুল মোমিন : ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্রি
smmomin80@gmail.com
Leave a Reply