(আজকের দিনকাল):রাষ্ট্রহীন, নিরাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী হয়ে উঠলে মিয়ানমারে বিভিন্ন বড় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ ভেস্তে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। এটিকে তিনি শুধু বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলের সমস্যা নয়, পৃথিবীর জন্য ফোড়া হয়ে উঠতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন।
শনিবার রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ডিপ্লোম্যাটস ম্যাগাজিনের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
সেমিনার শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আমরা সব সময় আশাবাদী। এই সমস্যার সমাধান হবে। তবে সেজন্য মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিশ্বে আমাদের যত বন্ধুদেশ আছে, তাদের আন্তরিকতা দরকার। তাদের অন্তরিকতা যদি থাকে, পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট থাকে; তাহলে নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সমস্যা দূর হবে। কিন্তু আন্তরিকতা না থাকলে সমস্যা দূর হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যদি এই সমস্যা দূর না হয়, তাহলে কী হবে? এশিয়া প্যাসিফিক, এই বে অব বেঙ্গলে অনেক দেশের আকর্ষণ বেড়েছে। প্রত্যেকেই এখানে অনেক বিনিয়োগ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। এই বিনিয়োগগুলো ভেস্তে যাবে যদি এখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ে। এই সন্ত্রাসী তৎপরতা যেন না বাড়ে, সেজন্য তাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, এখন কিছুদিনের জন্য হয়তো আমাদের এই অঞ্চলের জন্য সমস্যা হবে। কিন্তু সন্ত্রাসী বাড়লে, এই ১১ লাখ রোহিঙ্গা যাদের রাষ্ট্র নেই, কোনো আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই- আমাদের ভয় এদের অনেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে। যদি তারা সন্ত্রাসী হয়ে যায়, তাহলে বড় বড় দেশ যারা এখানে বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে, তাদের বিনিয়োগ ভেস্তে যাবে। সেজন্য তাদের নিজেদের তাগিদে এই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা অত্যন্ত প্রয়োজন। নয়তো এটি বিশ্বের জন্য এটি বড় ধরনের ফোড়া হয়ে উঠতে পারে।
এর আগে সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৬-২০২২ সালে মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনকিম ইনভেস্টমেন্টের একটি তালিকা তুলে ধরেন। সেখানে তিনি এই সময়ে মিয়ানমারে শীর্ষ বিনিয়োগকারী দেশের নামগুলো বলেন।
তিনি বলেন, এই তালিকার শীর্ষে আছে সিঙ্গাপুর। তারা সেখানে বিনিয়োগ করেছে ২৬ বিলিয়ন ডলার। চীন বিনিয়োগ করেছে ২২ বিলিয়ন ডলার, তৃতীয় বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশ থাইল্যান্ড বিনিয়োগ করেছে ১২ বিলিয়ন ডলার। হংকং বিনিয়োগ করেছে ১০ বিলিয়ন, যুক্তরাজ্য ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সংখ্যাগুলো উল্লেখ করে সবাই প্রকৃত চিত্র বুঝে নিতে পারবেন বলেও মন্তব্য করেন।
ডিপ্লোম্যাটস প্রকাশনীর নির্বাহী উপদেষ্টা আবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, ডিপ্লোমেটস ম্যাগাজিনের উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ফারুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ওবায়দুল হক, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জে. (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কূটনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন সমস্যার সমাধানে কমিশন গঠনের প্রস্তাব আসে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব।
সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীন ও যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোর পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে বলে জানান। পরে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বলেছেন তারা রোহিঙ্গা বিষয়ে আমাদের সহায়তা করেই যাবে। তারা এজন্য একজন সিনিয়র ফোকাল এনভয় নিয়োগ করেছে। একইভাবে চীনও এ বিষয়ে স্পেশাল ফোকাল এনভয় নিয়োগ করেছে। আমাদের এখন আশা, এই আন্তরিকতার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে। তিনি বলেন, আমরা শান্তিময় দেশ, ধৈর্য ধরলে এর ভালো ফল পাওয়া যায়।
সমস্যা সমাধানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বিশ্বের ১৩৪টি দেশ জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমার এখনো আন্তরিক নয়। তারা তারিখের পর তারিখ দিয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। তবে আমরা কখনোই আশা ছাড়িনি। তিনি বলেন, নিজেদের স্বার্থেই বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
রোহিঙ্গাদের জন্য ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ভাসানচরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ করেছে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এত টাকা খরচ করার মতো ধনী দেশ নয়।
আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশ কিংবা এই অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি এখন বিশ্বের জন্য একটি থ্রেট। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন না হলে অস্থিরতা বাড়বে।
সেমিনারে অনলাইনে যুক্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল পলিসিমেকার গারেথ জন ইভানস বলেন, রোহিঙ্গাদের এভাবে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা এবং অবস্থান বাংলাদেশের জন্য একটা দুঃস্বপ্ন। মিয়ানমার যা করেছে, সেটি আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার, ব্যবহার এবং মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
Leave a Reply