অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে পড়তি মূল্যের কারণে আগামী বছরে চাল ও গম আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি সাশ্রয় হবে ওএমএস কর্মসূচির ভর্তুকিতে চারশ কোটি টাকা।
এমনটি হিসাব করেই আগামী বাজেটে খাদ্য খাতের মোট ব্যয়ের আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে আগামীতে খাদ্যশস্য আমদানির চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে সংগ্রহকে।
এজন্য দেশের উৎপাদিত চাল ও গম সংগ্রহের জন্য চলতি বছরের তুলনায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সূত্র আরও জানায়, খাদ্য খাতে মোট ব্যয়ের মধ্যে পরিচালনা খাতে ১৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন খাতে ৯৩২ কোটি টাকা খরচ করা হবে। খাদ্য আমদানিতে বরাদ্দ আছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহে বরাদ্দ নয় হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আর সার্বিক ভর্তুকিতে ব্যয় হবে আট হাজরা ৭৫৭ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন জানান, বিশ্ববাজারে আগামী অর্থবছরে খাদ্যমূল্য চলতি বছরের তুলনায় কমবে। পাশাপাশি দেশের খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতিও ভালো হবে। এতে আগামীতে খাদ্য খাতে চাপ কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছি।
বিশেষ করে গরিব মানুষের কম মূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি ওএমএস’র ওপর চাপ আগামীতে কমে আসবে। সে লক্ষ্যে এই কর্মসূচিতে চাল বিতরণের লক্ষ্যমাত্রাও হ্রাস পাবে। যার ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বাজেটে।
জানতে চাইলে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানান, মূল্যস্ফীতি কমানোর নজির এ বিশ্বে খুব বেশি নেই। আগামী বছরে এটি মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। তবে খাদ্য সরবরাহসহ নিত্যপণ্য কম দামে সরবরাহ করা গেলে সাধারণ মানুষ কিছুটা রেহাই পাবেন।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেকটা কমমূল্যে চালসহ খাদ্যশস্য সরবরাহ করার কর্মসূচি যৌথভাবে সরকার ও মালিকপক্ষ করতে পারলে উৎপাদনশীল এই শ্রমিকদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দিতে পারে। এ জন্য খাদ্য খাতে বরাদ্দ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সূত্রমতে, খসড়া হিসাবে আগামী বাজেটের ২ দশমিক ৭১ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে খাদ্য খাতে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ বরাদ্দ দিয়ে বাজারে অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করা যাবে। যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
জানা গেছে, চালের একটি বড় অংশ বিতরণ হয় ওএমএস কর্মসূচিতে। এটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে বলা হয়। কারণ বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতির ফলে বাজারে চালের মূল্য অনেক বেশি। গরিব মানুষকে সেখান থেকে লাগব দেওয়ার জন্য কম মূল্যে ওএমএস’র মাধ্যমে চাল বিক্রি করে থাকে সরকার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এই কর্মসূচিতে তিন লাখ ৫০ হাজার টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে এ কর্মসূচির ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে সংশোধিত বাজেটে ওএমএস’র আকার বাড়িয়ে ৫ লাখ ৯০ হাজার টন করা হয়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বছরে ওএমএস কর্মসূচির চাহিদা বেশি থাকবে না। কারণ দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ভালো হবে। এতে চালের মূল্য আরও কমে আসবে। ফলে এই কর্মসূচি পরিচালনার জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চার লাখ টন চাল বরাদ্দ রাখা হবে।
জানা গেছে, বিভিন্ন খাদ্য কর্মসূচি পরিচালনার জন্য প্রতিবছর সরকার বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি করে। এরজন্য বাজেটে অর্থসংস্থান রাখা হয়।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে বিদেশ থেকে চাল আমদানির জন্য এক হাজার ৯১৯ কোটি টাকা এবং গম বাবদ ২ হাজার ৮১ কোটি টাকা সংস্থান রেখেছে। তবে এরপরও এ খাতের বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানির জন্য বরাদ্দ আছে ৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, বিশ্ববাজারে চাল ও গমের মূল্য কমতির দিকে থাকায় আমদানি ব্যয় কম হবে। এছাড়া একটি বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী এ বছর প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল ও গম আমদানি করে মজুদের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি চাল ও গম আমদানি করা হয়। যা আগামী বছরে এ ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন হবে না।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী চাল ও গমের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি গম নিয়ে সংকট তৈরি হয়। কারণ ইউক্রেনের উৎপাদিত গম বিশ্বের ৫০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের মূল্যও বৃদ্ধি পায়।
ফলে একদিকে সংকট এবং সংকটে মূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। যে কারণে ওএমএসসহ অন্যান্য কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বিতরণ পরিচালনায় ভর্তুকির অঙ্কও বৃদ্ধি পায়। এতে দেখা গেছে, বছরের শুরুতে ছয় হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে ৮১২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে এ খাতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায় আগামী অর্থবছরে খাদ্য খাতে মোট ভর্তুকি আরও ১২শ কোটি টাকা বেড়ে আট হাজার ৭৫৭ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। তবে সার্বিক ভর্তুকি ব্যয় বাড়লেও শুধু ওএমএস খাতে ভর্তুকি কমবে ৪০৬ কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, এ বছর কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের জন্য ৮ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা এবং গম সংগ্রহের জন্য ৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর দেশে ধান ও চালের উৎপাদন বাড়বে। এজন্য আমদানির বিপরীতে কৃষকের কাছ থেকে খাদ্যশস্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।-যুগান্তর
Leave a Reply