আজ ২৮শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রিয়েল এস্টেটের আড়ালে এমএলএম তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট

(আজকের দিনকাল):২৬ হাজার গ্রহকের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেড। এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) পদ্ধতিতে প্রতারণা করছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আকতার হোসেন সোহেল এমএলএম প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডেসটিনি অকার্যকর হওয়ার পর তিনি প্রতারণার নতুন ফাঁদ পাতেন। সারা দেশেই তিনি ফেলেছিলেন জাল। তার জালে বেশি পড়েছেন সাবেক সেনা সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চলছিল অভিনব প্রতারণা। সম্প্রতি উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের এবং বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগ পড়ার পর গা ঢাকা দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে এক পরিচালককে গ্রেফতার করেছে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। রোববার তাকে গ্রেফতারের পর সোমবার আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, একেক শ্রেণির লোকের কাছে একেক ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তরা। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে নিজেকে একজন সাবেক জিওসির ছেলে পরিচয়ে আকতার হোসেন সোহেল বলতেন, ‘আমি আপনাদের সন্তান। সেনাবাহিনীর রেশন খেয়ে বড় হয়েছি। আপনারা আমার বাবার মতো। আমি কি আপনাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারি?’ সাধারণ মানুষের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমে ঢাকার আশপাশে কোনো প্রক্রিয়াধীন আবাসন প্রকল্পে নিয়ে যান ব্রাইট ফিউচারের কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে মিডিয়া হিসাবে জায়গা-জমির দাম-দর করেন। এরপর টাকা নেন। কিন্তু তারা প্লট দিতে পারেন না। গ্রাহক টাকা ফেরত চাইলে বলেন, ‘আমরা তো মিডিয়া হিসাবে কাজ করি। প্লটের জন্য যাদের কাছে টাকা দিয়েছি, তারা সেই টাকা অন্য প্রকল্পে ব্যয় করে ফেলেছে। তাই এ মুহূর্তে আপনার টাকা ফেরত দেওয়া যাবে না। আমাদের নিজস্ব প্রকল্প আছে। আপনি চাইলে আমাদের প্রকল্পে এই টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনার বিনিয়োগের টাকার ওপর প্রতিমাসে লাখে তিন হাজার টাকা করে লাভ দেওয়া হবে। চার বছর পর আপনাকে মূলধনের দ্বিগুণ ফেরত দেওয়া হবে।’

সূত্রমতে, ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেড যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, তাদের কাউকেই টাকা ফেরত দেয়নি। ঠিকমতো লাভও দেয়নি। দুই-এক মাস লাভ দেওয়ার পর টালবাহানা শুরু করে। এ বিষয়ে ৪ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী মীর মো. জান্নাত হোসেন। মামলায় ২০-২২ জনকে আসামি করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এই জালিয়াতচক্রে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছেন। মামলার আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি আকতার হোসেন সোহেল, পরিচালক আলতাব হোসেন, মোজাম্মেল হক, হারুন অর রশিদ বাবু, হারুন অর রশিদ, মনির হোসেন, রাজা-উল করিম, ডিএমডি পারভিন আক্তার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আহম্মেদ এবং উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের কাজী শামসুর রহমান।

মামলার এজাহারে মীর জান্নাত হোসেন বলেন, ‘আসামিরা প্রলোভন দেখায় যে, আশুলিয়ার ইছরকান্দি মৌজায় তাদের অনেক জমি কেনা আছে। সেখানে আমাকে স্বল্প দামে পাঁচ কাঠার প্লট কিনতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের কথায় বিশ্বাস করে আমি ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্লটের জন্য আট লাখ টাকা দিই। পরে ২০২২ সালের ১০ আগস্ট আরও ৫০ হাজার টাকা দিই। শুধু তাই নয়, তাদের প্রলোভনে পড়ে আমি বিভিন্ন সময়ে আমার কয়েকজন আত্মীয়র কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়ে তাদের দিই। কিন্তু তারা আমাকে প্লট দিতে পারেনি। টাকা ফেরত চাইলে লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। কিন্তু লভ্যাংশও দেয়নি। বেশ কিছুদিন ঘোরানোর পর এখন তারা পলাতক।’

গত জানুয়ারিতে পুলিশের এক গোপনীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়িতে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেডের অফিস রয়েছে। সেখানে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেন হচ্ছে। পাওনা টাকা নিয়ে অনেকেই বিরোধে জড়াচ্ছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি সেখানে এ নিয়ে আন্দোলনও হয়। বাড়িটি ঘেরাও করে আমানতকারীরা। কিন্তু টাকা লেনদেনসংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা পুলিশের এখতিয়ারবহির্ভূত। তারপরও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের কাছে গ্রাহকরা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানায়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যে কোনো সময় তারা পালিয়ে যেতে পারে।’

রোবাবার রিমান্ড আবেদনে উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাসান মাহামুদ উল্লেখ করেন, গ্রেফতার মোজাম্মেলসহ এজাহারভুক্ত আসামিরা সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যাদের গ্রেফতার করা যায়নি, তারা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে। অন্য আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানা ও পাসপোর্ট নম্বর সংগ্রহের জন্য মোজাম্মেলকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন।

ভুক্তভোগী মেজর (অব.) মাহমুদ আকবর ভূঁইয়া বলেন, ২০১৯-২০ সালে আমি ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেডে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। তারা আমাকে প্রতিমাসে লভ্যাংশ দিয়ে চার বছরের মধ্যে ৪৮ কিস্তিতে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। সে অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে আট কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু কয়েকটি কিস্তি দেওয়ার পরই তারা লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। লভ্যাংশসহ তাদের কাছে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা পাব। বেশ কয়েকবার তাদের অফিসে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা লাপাত্তা। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করতে পারছি না।

থানায় দেওয়া অভিযোগে লাভলী খাতুন নামের এক ভুক্তভোগী উল্লেখ করেন, ‘সরলবিশ্বাসে ব্রাইট ফিউচারের কাছে আমি ৩৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ টাকা পরিশোধ করি। আমাকে ৪৫টি কিস্তির মাধ্যমে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও ২-৩টি কিস্তি দেওয়ার পর থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।’ মহিউদ্দিন, হামিদা আলম, শাহানাজ, রফিক, রশিদ, সাজ্জাত, রুদ্র, আইয়ুবসহ আরও অনেকেই যুগান্তরের কাছে নিজেদের প্রতারিত হওয়ার কাহিনি তুলে ধরেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেডের প্রতারণার বিষয়টি আমরা অবগত। একাধিক অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে চক্রের একজনকে ধরেছি। বাকিদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।-ডেস্ক

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ