এমন ভূমিকার পরও বলব, গাজীপুর নির্বাচন ও এর ফল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যাল নিয়ে এসেছে। নির্বাচনের ফল নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের গভীরভাবে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে আমরা যারা কাগজে নিয়মিত কলাম লিখি, বা আমার মতো যারা লেখার আগ্রহ ক্রমে হারিয়ে ফেলছি, তাদের অনেকেই নিকট অতীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সতর্ক করে দিয়ে অনেকবারই লিখেছি, উন্নয়নের সাফল্য দেখিয়েই নির্বাচনের মাঠে ভোটারের মনোরঞ্জন করা যায় না। আর নির্দিষ্ট ভোটব্যাংককে দুর্ভেদ্য মনে করে স্বস্তিতে থাকারও অবকাশ নেই। মানুষের আস্থায় আসতে হবে। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন সরকারের সুশাসনের পথে হাঁটা।
নৌকার পরাজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নানা রকম কারণ খুঁজছেন। এর কোনো কোনোটি দৃশ্যপটে অনেকটা স্পষ্টও। যেমন কোনো কোনো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের তৃণমূল নেতার, আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষায়, ভোটের মাঠে বিশ্বাসভঙ্গ করা। জায়েদা খাতুনের কর্মীদের নীরবে কাজ করে যাওয়ার কৌশল। বিএনপি ভোটারদের নৌকাবিরোধী ভূমিকা ইত্যাদি। কিন্তু এসব কারণের পেছনের কারণ খোঁজার চেষ্টা আছে কিনা আমাদের জানা নেই।
একটি বিষয় এখনো আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় না, যা হলো-দলীয় কাঠামোর বাইরে মুক্তচিন্তার সাধারণ ভোটারও আছেন, যাদের কোনো দলের প্রতি মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন থাকে-তাদের জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর ভাবা হয় কিনা। আমাদের বিচারে এই ভোটাররা জয়-পরাজয় নির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমন, আওয়ামী লীগের নীরব সমর্থক হলেও দলের বা দলীয় সরকারের ভূমিকা তাদের আনন্দ দেয় বা আহতও করে। বিএনপির ক্ষেত্রেও অভিন্ন মন্তব্য। তারা কষ্ট পেয়ে অভিমান করে যদি অন্য কোনো মার্কায় ভোট না দিয়েও ভোটদানে বিরত থাকেন, তাতে যে কোনো বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। গাজীপুরে নৌকা মার্কার পক্ষে যে সংখ্যক ভোট পড়েছে তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগর ভোটব্যাংক বলে পরিচিত ভান্ডার থেকেও অনেক ভোট বেরিয়ে গেছে। টেবিলঘড়ি সংগত কারণে আওয়ামী লীগের কিছু ভোট পেয়েছে। বিএনপি সমর্থকদের অধিকাংশ ভোট পেয়েছে ঘড়ি। আর নারী ভোটারদের উল্লেখযোগ্য ভোট যে পেয়েছে, তা ধরে নেওয়াই যায়। টার্গেট ঠিক করে নির্বাচনের দিন বড়সংখ্যক নারী ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে পারার কৃতিত্ব জায়েদা খাতুনের কর্মীদেরই। গাজীপুরের অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। তাদের অধিকাংশকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসাবেই জানি। নির্বাচন প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি, তারা আওয়ামী লীগের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের প্রতি খুব খুশি নন। তাদের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ নেতারা তৃণমূল নেতাকর্মীদের তেমন মূল্যায়ন করেন না। এ কারণে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ ক্ষোভ রয়েছে।
নিজের কথাই যদি বলি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিুগামিতার কারণে ছাত্রজীবনে যেমন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পারিনি, শিক্ষকজীবনেও দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। বাস্তবে দেখলাম আমাদের মতো রাজনীতিসংশ্লিষ্ট না থাকা মানুষ যথেষ্ট কোণঠাসা অবস্থায় থাকেন। দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্পে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একাডেমিক পরিবেশ ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক-অফিসার-কর্মচারী নিয়োগে সব সরকারের আমলে যে রকম দলীয়করণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে-যেভাবে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত, দিনশেষে বর্তমান বাস্তবতায় তা আওয়ামী লীগের গায়েই কালো আঁচড় কাটে। মন্দের ছড়াছড়িতে ভালো আড়ালে চলে যাচ্ছে। আমলাতন্ত্রের হামবড়া ভাব বেড়ে গেছে। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আমলাদের ওপর এখন ব্যাপক নির্ভরতা রাজনৈতিক দলগুলোর। আমলারা সরকারের ঘাড়ে চড়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন; কিন্তু সাধারণ মানুষ কাক্সিক্ষত সহযোগিতা তাদের কাছ থেকে পাচ্ছে না। প্রশাসনিক দুর্নীতি তো আর রাখঢাকের বিষয় নয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বলে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করা যাবে না। ছোট্ট দেশ আমাদের। সাধারণ মানুষ সাদা চোখেই দেখতে পায় সরকারের ছত্রছায়ায় বসে কেমন করে অনেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে তাদের কষ্টের কারণ হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি আশার কথা শুনিয়েছেন যে, দুর্নীতি নাকি অনেক কমেছে। তেমনটি হলে তো আনন্দের সীমা থাকে না। আমরা মনে করি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত না করে দলীয়করণের বাতাবরণে এগোতে থাকলে ভোটের মাঠে এর বিরূপ প্রতিফলন পড়তে বাধ্য।
উন্নয়ন দেখিয়ে ভোটের মাঠে সামান্য অনুকূল ফল লাভ করা যেতে পারে-অনেকটা নয়। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বড় ধরনের উন্নয়ন সন্দেহ নেই। কিন্তু আঠারো কোটি মানুষের দেশে এসবের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী বড়জোর দশ ভাগ মানুষ। বাকি নব্বই ভাগ মানুষ যাপিতজীবনের দুঃখ-কষ্ট নিয়েই আছে। এ কারণেই বলব, সাধারণ ভোটারকে হিসাবের বাইরে রেখে দলীয় দৃষ্টিতে ভোটের জয়-পরাজয় মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
গাজীপুর নির্বাচন বিএনপি নেতৃত্বকে আরও বড় সিগন্যাল দিয়ে গেল। যৌক্তিক রাজনৈতিক পথে না থেকে বরাবরের মতো অন্ধকার পথে আলো খুঁজছে বিএনপি। সরকার পতনের একদফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ঘটানো-এসব মুখরোচক কথা বিএনপি শিবির থেকে খুব বলা হচ্ছে। গা গরম করার কর্মসূচি নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে কয়েকবার। কিন্তু সরকারের পতন ঘটানোর জন্য যে গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখছেন বিএনপি নেতারা, তার প্রস্তুতিমূলক প্রভাব কোথায় জনজীবনে! সরকারবিরোধী আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থান করতে হলে এর বাস্তবতা এতদিনে সমাজজীবনে ছড়িয়ে পড়ার কথা। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার কথা গ্রামেগঞ্জে, শহরে-বন্দরে, অফিস-আদালতে। জনপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতার ডাকে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে-বিএনপিতে তেমন দৃশ্যমান নেতা কোথায়! তার চেয়ে বড় কথা, সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে যে বিএনপি, সে দল ২৮ বছর সরকার পরিচালনা করেও দৃশ্যমান বড় কোনো উন্নয়নের কথা এখনো উদাহরণ হিসাবে আনতে পারছে না। অন্যায়-দুর্নীতির কম রেকর্ড গড়েনি তারা। আজ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নানা অভিযোগ তুলতে পারলেও বিএনপিকে মানুষ কোন ভরসায় এগিয়ে রাখবে? এমন বাস্তবতায় বিএনপি ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক শক্ত অবস্থান তৈরির আগেই নির্বাচনে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেল। ঘোষণা করে দিল এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ কারণে তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বোঝা উচিত ছিল স্থানীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তৃণমূল নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাইবে না। আন্দোলন করে সরকার পতন অনিবার্য হলেই কেবল তৃণমূল নেতারা ঝুঁকি নিতে পারেন; কিন্তু তারা তো বিএনপির চলমান আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে সংগত কারণেই নিশ্চিত নন। তাই বহিষ্কারের খড়্গ মাথায় নিয়েও অনেক স্থানীয় বিএনপি নেতা কাউন্সিলর পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং ১৫ জন জয়ীও হয়েছেন।
নির্বাচন গড়াপেটা করা নিয়ে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। এ অঙ্কটি বিএনপি নেতারা করতে পারেননি। তারা একদফা দাবি আদায় ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না বলে দেশ-বিদেশে মেসেজ পাঠিয়েছেন। আর অন্যদিকে গাজীপুর নির্বাচনে নিজ প্রার্থী হেরে গেলেও সন্ত্রাসবিহীন অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটা এগিয়ে গেছে। সাধারণ যুক্তিতে মনে করা যায়, অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সরকার নিজ ইমেজ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করবে। তেমনটি করতে পারলে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এর একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণেই আমরা মনে করি, রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে হলে এ নির্বাচনের ট্রেন বিএনপির মিস করা আত্মঘাতী হবে। শেষ পর্যন্ত অনেক কিছু হারিয়ে তারা হয়তো ট্রেন ধরবে। এমন বাস্তবতা সামনে রেখে রাজনীতির কৌশলে বেরিয়ে আসার পথ খোলা রাখা প্রয়োজন ছিল।
আঠারো কোটি মানুষের দেশে সারা দেশের প্রতিবাদী সমাবেশ বা পদযাত্রার যোগফলে আট-দশ লাখ মানুষও হয়তো হবে না। তাছাড়া আমাদের দেশের বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে এক অংশ থাকে ভাড়া করা ‘জনগণ’। এ বাস্তবতায় যদি বিএনপি নেতারা গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখেন, তাহলে স্বপ্নভঙ্গের পরে কেমন দশা হবে? এমন ক্ষেত্রে অনেক সময় সাফল্য আসে অন্ধকারের কোনো শক্তি হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়ালে। অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতারা ততক্ষণে এসব ছিদ্র কি বন্ধ করবেন না?
আমাদের মনে হয়, বিএনপির জন্য সবচেয়ে ভালো হবে গাজীপুর নির্বাচন থেকে আসা মেসেজটি পড়তে পারলে। যদি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি বড় লড়াই গড়ে তুলতে পারার কথা বিএনপির। এ সুযোগটি হাতছাড়া করলে রাজনীতির সূত্রে বিএনপি অনেকটা পিছিয়ে পড়বে।
শুনেছি ফুল থেকে মৌমাছি নেয় মধু আর মাকড়শা নেয় বিষ। আমাদের বড় দলগুলো শেষ পর্যন্ত কী নেয় তাই-ই দেখার বিষয়।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
Leave a Reply