(আজকের দিনকাল):দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা অবৈধ সম্পদের মামলায় বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমানের ১৩ বছর ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানের তিন বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। দুদকের দায়ের করা অবৈধ সম্পদের অপর মামলায় বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ৯ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, রাজনীতিবিদরা জনগণ ও দেশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করার লক্ষ্যে রাজনীতিতে জড়িত হন। কারণ রাজনীতি হচ্ছে জনগণ ও দেশের কল্যাণে এক ধরনের মহান ত্যাগ ও নিষ্ঠার কাজ।
ফলে রাজনীতিবিদরা জনগণের সম্পদের রক্ষক হবেন, তারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। আদালত বলেন, বৈধ ব্যবসা এবং অন্যান্য পেশার আশ্রয় নিয়ে অর্থ-সম্পত্তি অর্জনের অনেক উপায় রয়েছে।
তবে অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনীতি কোনো পেশার আওতায় আসতে পারে না। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমান দম্পতি ও ইকবাল হাসানের আপিল খারিজ করে মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে আমান, তার স্ত্রী ও টুকুকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এমনটিই জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন আমান দম্পতির আইনজীবী নাজমুল হুদা।
তথ্যমতে, ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় দুদকের দায়ের করা সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আমান উল্লাহ আমানকে ১৩ বছর ও তার স্ত্রী সাবেরাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। অপর এক মামলায় বিচারিক আদালত ইকবাল হাসানকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। পৃথক ওই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করেছিলেন। ওই সময় তারা জেলও খাটেন।
গত ১৭ মে সম্পদের মামলায় সাজার বিরুদ্ধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর আপিলের রায়ের জন্য মঙ্গলবার (৩০ মে) দিন ধার্য করা হয়। অন্যদিকে গত ১৪ মে দুর্নীতির মামলায় বিএনপির নেতা আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানের খালাসের রায় বাতিল করে হাইকোর্টে আপিলের পুনঃশুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্যও এ দিনটি ধার্য করা হয়।
হাইকোর্টে আমান দম্পতির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী নাজমুল হুদা। ইকবাল হাসানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. সাইফুল্লাহ মামুন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন। দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে : জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার আদালতে রায়ের মূল অংশ পড়ে শোনান। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, দুর্নীতি সব বয়সি এবং বর্ণের মানুষকে প্রভাবিত করে। দুর্নীতি দরিদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করে। এ কারণে দেশের জনগণ, বিশেষ করে দায়িত্বশীল স্টেকহোল্ডারদের একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত; যে তারা কেবল দুর্নীতির শিকারই নন, এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল খেলোয়াড়ও। আদালত রায়ে আরও বলেন, যদি বিশ্বে পরিবর্তন আনতে চান এবং বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চান তাহলে এর বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনার জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি হিসাব দেওয়ার দায়িত্ব থাকতে হবে। আইনের বিধান অনুসরণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ছেলেবেলা ও বাল্যকাল থেকেই শিশুদের সততা ও অসততার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখানো উচিত বলে মন্তব্য করেন আদালত।
পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেন, দুর্নীতিবাজরা তাদের সমালোচকদের চুপ করতে এবং চুরি করা সম্পদ লুকানোর জন্য একে অপরকে সাহায্য করে। তাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে। আদালত বলেন, বিশ্ব ও বাংলাদেশের পরিবর্তনের অপেক্ষায় নাগরিকরা বসে থাকতে পারে না। আমাদের প্রত্যেককে সেই পরিবর্তনের অংশ হতে হবে। বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাদেশি ছাড়া কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে না। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাইকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। বিশ্বে ও বাংলাদেশে দুর্নীতির অবসান ঘটানো লক্ষ্য হওয়া উচিত উল্লেখ করে আদালত বলেন, একটি বৈশ্বিক আন্দোলন হিসাবে আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বে এবং বাংলাদেশে দুর্নীতির অবসান ঘটানো। তা যেখানেই হোক বা যে রূপেই হোক না কেন। আমরা জানি যে সফল হওয়ার একমাত্র উপায় হলো নাগরিকদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত করা। আমরা সমাজ থেকে সব ধরনের দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের উপশম প্রতিরোধ এবং মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়া হবে : রায়ের পর আমান দম্পতির আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমান উল্লাহ আমান সম্পদের কোনো তথ্যই গোপন করেননি। যেসব সম্পদের বিবরণ দুদকে দেওয়া হয়েছে, সেসব সম্পদের কর দেওয়া হয়েছে। ফলে আমরা আশা করছিলাম আমান উল্লাহ আমান খালাস পাবেন। কারণ এই আদালতেই মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। এই মামলার শুনানিতে মায়ার মামলার উদাহরণ, নজির দেখিয়েছি। কিন্তু আদালত বিচারিক আদালতের সাজাই বহাল রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, এ রায়ে আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী ন্যায়বিচার না পাওয়ায় সংক্ষুব্ধ। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আর রায়ের অনুলিপি পেলে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাওয়া হবে।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর আইনজীবী সাইফুল্লাহ মামুন জানান, হাইকোর্টের এ রায় বিচারিক আদালত গ্রহণ করার দুই সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তা করে জামিন চাওয়া হবে। তবে আমার মক্কেল মনে করছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি ন্যায়বিচার পাননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, বিচারিক আদালত হাইকোর্টের রায় গ্রহণ করার দিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে দণ্ডিতদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : চার কোটি ৯৬ লাখ ১১ হাজার ৯১৬ টাকার সম্পত্তির হিসাব ও আয়ের উৎস গোপন করার অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ২০০৭ সালের মার্চে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। দুদকের উপপরিচালক এসএমএম আখতার হামিদ ভূঁঞা ওই বছরের ২৮ জুন মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। মামলার বিবরণে আরও জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত এ মামলার রায়ে টুকুকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে টুকু আপিল করলে ২০১১ সালের ১৫ জুন তাকে খালাস দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি খালাসের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির আদেশ দেন আপিল বিভাগ। সে অনুযায়ী হাইকোর্টে শুনানি হয়।
আমান উল্লাহ আমান ও স্ত্রী সাবেরা আমান : সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আমান দম্পতির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। ওই বছরের ২১ জুন বিশেষ জজ আদালতের রায়ে আমানকে ১৩ বছরের ও সাবেরাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট সেই আপিল মঞ্জুর করে তাদের খালাস দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে ২০১৪ সালের ২৬ মে আপিল বিভাগ সে রায় বাতিল করে হাইকোর্টকে মামলাটির আপিল পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী হাইকোর্টে শুনানি শেষে মঙ্গলবার রায় দিলেন। এদিকে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
প্রতিবাদে রাজধানীতে বিএনপির বিক্ষোভ : আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সব ‘হয়রানিমূলক’ মামলার রায় স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে মামলা, হামলা ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, আমানউল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার সাজা বহালের রায়ের প্রতিবাদে এ বিক্ষোভ সমাবেশ করে নেতাকর্মীরা। মিছিলটি নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়। নাইটিঙ্গেল মোড় হয়ে পল্টন থানার সামনে দিয়ে পুনরায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারসহ মহানগর বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী।-যুগান্তর
Leave a Reply