(আজকের দিনকাল):জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, সবার অজান্তেই বাংলাদেশ এখন শ্রীলংকা হয়ে গেছে। আমরা আগেই বলেছিলাম দেশ শ্রীলংকার দিকে যাচ্ছে। তখন শ্রীলংকা তেল ও কয়লা কিনতে পারেনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারেনি। আমদানি করতে পারেনি, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বেড়েছিল। ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আমরা শ্রীলংকাকে দেউলিয়া বলেছিলাম। তখন সারা বিশ্বের মতোই আমরা শ্রীলংকা নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলাম। এখন তো আমাদের অবস্থাও তাই। বিদ্যুৎ নেই, জিনিসপত্রের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চেয়ে অনেক কম। এখন শ্রীলংকার চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি। সবার আয় কমে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে, এটাই শ্রীলংকা। সরকার বলে, ঋণ পরিশোধে আমরা ব্যর্থ হইনি। যদি আপনারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ না হন, তাহলে আন্তর্জাতিক সংস্থা মুডিস কেন বলে বাংলাদেশে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বাকিতে মালামাল কিনে সরকার দেশের মানুষের মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
শনিবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে জাতীয় যুব সংহতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
এ সময় তিনি আরও বলেন, শ্রীলংকা আর আমাদের মধ্যে তফাত হচ্ছে-শ্রীলংকার মানুষ দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছে। শ্রীলংকার মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নামেনি, বিক্ষোভ করেনি। কারণ, শ্রীলংকার পুলিশ আন্দোলনকারীদের গুম করেনি, লাঠিচার্জ করেনি এবং গুলিও করেনি। সে দেশের পুলিশ আন্দোলনকারীদের দেশের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করেছে। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছে সেদেশের পুলিশ। বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নামেনি দুটি কারণে-এক. তারা জানে না দেশ শ্রীলংকা হয়ে গেছে। দুই. রাস্তায় নামলে তাদের কী হবে, তা কেউ জানে না। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলে জনগণ বাঁচতে পারবে কি না, ব্যবসা নিয়ে টিকতে পারবে কি না এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত সবাই।
জিএম কাদের বলেন, আন্দোলন করলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। আমরা কি ব্রিটিশ আমলে আছি? পাকিস্তান আমলে আছি? আমাদের টাকায় বন্দুক কিনে পুলিশ আমাদের বুকে গুলি চালায়। শ্রীলংকার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য একটাই-শ্রীলংকার মতো জনগণ মঠে নামেনি, কারণ আন্দোলন করলে জবাই করার জন্য পুলিশ রেডি হয়ে আছে। আমরা দেশকে শ্রীলংকা হতে দেব না। যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছে। দেশের মানুষ যেন দোজখের আগুনে পুড়ছে। শারীরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে দেশের মানুষ বিপর্যস্ত। রিজার্ভ নেই, তাই বিদেশে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে ডলার তুলতে পারে না। অপরদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, তিন থেকে চার মাস চলার মতো রিজার্ভ আছে। সরকারের কাছে সমস্যা নাও থাকতে পারে; কিন্তু দেশবাসী বিরাট সমস্যায় পড়েছে। টাকা থাকলে তেল, কয়লা কিনছেন না কেন? সাধারণ মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে পারছেন না কেন? কালকারখানার কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দিচ্ছেন না কেন? তিন-চার মাসের রিজার্ভ থাকলে এমন অবস্থা হবে কেন? ঋণনির্ভর বাজেট করার কারণে দেশের মানুষকে ট্যাক্সের ফাঁদে ফেলে শোষণ করা হচ্ছে। অপরদিকে বিশ্ব থেকে ঋণ এনে সেই টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। আমরা কোথায় যাই, কী করি, তা প্যাগাসাস দিয়ে অনুসরণ করা হয়। ফাঁদ পেতে আমাদের ছবি তুলতে চেষ্টা করা হয়। যারা কানাডায় বাড়ি তৈরি করে, যারা দুবাইয়ে ব্যবসা খোলে, তাদের পেছনে গোয়েন্দা লাগান না কেন? জিএম কাদের কি সহিংসতার সঙ্গে জড়িত? আমাদের ভয় পাচ্ছেন কেন? আমরা তো জনগণের পক্ষে কাজ করছি। হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। দেশের মানুষ বৈষম্য, স্বৈরতন্ত্র, অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে মুক্তি চেয়েছিল। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে; কিন্তু মুক্তি পায়নি। আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করেছি; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করিনি। এখনো স্বৈরশাসন আছে, নির্যাতন-নিপীড়ন আছে। দেশের মালিকানা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে, গণতন্ত্র হাতছাড়া হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, স্বৈরশাসন এসেছে অজান্তে, এক ব্যক্তি শাসন এসেছে সবার অজান্তে। সবার অজান্তে এক ব্যক্তি ও এক দলের শাসন এসেছে দেশে। এখন ‘আওয়ামী লীগ প্লাস’ দেশ চালাচ্ছে। এখন পুলিশ প্রশাসনসহ সবাই আওয়ামী লীগের কথা বলে। তারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মেগা প্রকল্প থেকে টাকা লুটপাট করে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। আর এ কারণেই স্যাংশন ও ভিসানীতির কথা এলেই তারা ঘাবড়ে যায়। কারণ, ইউরোপ-আমেরিকায় তাদের বাড়িঘর আছে, সম্পদ আছে। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমেরিকা যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, তা বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসবে।
জিএম কাদের বলেন, দেশের মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে না। তারা মনে করছে, আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় নিতে আমরা নাটক করছি। কারণ, আমাদের কিছু মানুষ দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে। আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, আমাদের লাঙ্গল নিয়ে যাবে, আমার চেয়ারম্যান পদ কেড়ে নেওয়া হবে। আমরা লাঙ্গল বা চেয়ারম্যান পদ পাওয়ার জন্য লালায়িত নই। মানুষের অন্তরে আমরা স্থান করে নিতে চাই। কে কী করল, কী করবে, তাতে আমরা ভীত নই। একক হলেও আমি দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব। দল নিয়ে বেচাকেনা করতে দেওয়া হবে না। যারা জাতীয় পার্টিতে থেকে আরেক দলের কথা বলেন, তাহলে সেই দলে চলে যেতে পারেন। নেতাকর্মীদের এত ত্যাগ অথচ কয়েকজন মানুষের জন্য আমরা দালাল পার্টি হিসাবে পরিচিত হচ্ছি। যারা দালালি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্মেলনে মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১২ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীদের মাঝে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পর্যন্ত আর কত টাকা পাচার হয়েছে, তা এখনো অজানা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতে জাতীয় পার্টি গণমানুষের আস্থা অর্জন করে তৃতীয় শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হতে পারবে।
দলের কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, পল্লীবন্ধুর সমালোচনা করতে অনেকেই বলেন, সেনাছাউনি থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। দেশের জন্য যারা বড় বড় অবদান রেখেছেন, তাদের অনেকেই সেনাছাউনি থেকে এসেছেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনা কর্মকর্তারাই সেক্টরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আবার মাঠের মূল নেতৃত্ব ছিল জেনারেল ওসমানীর হাতেই। তিনি বলেন, পল্লীবন্ধুর স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়তে আমরা কাজ করছি।
কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, রাজনীতির আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। সবাইকে সুশৃঙ্খল থেকে রাজনীতি করতে হবে। তিনি বলেন, যুব সংহতিকে দায়িত্ব নিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি, ঐক্যবদ্ধ থাকব।
কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, কোনো ষড়যন্ত্রই জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারবে না। যারা ষড়যন্ত্র করবে, তাদের আর ছাড় দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টি হচ্ছে দেশের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে কেউই দেশের ক্ষমতায় যেতে পারবে না।
জাতীয় যুব সংহতির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে জাতীয় যুব সংহতির আহ্বায়ক ও ভাইস চেয়ারম্যান এইচএম শাহরিয়ার আসিফের সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব আহাদ ইউ চৌধুরী শাহিনের পরিচালনায় সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি, সৈয়দ আব্দুল মান্নান, শফিকুল ইসলাম সেন্টু , লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এমপি, নাসরিন জাহান রতনা এমপি, নাজমা আকতার এমপি, আলমগীর সিকদার লোটন, সৈয়দ দিদার বখত, জহিরুল ইসলাম জহির, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা রওশন আরা মান্নান এমপি, হারুন অর রশিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল হক, ইঞ্জিনিয়ার মনির আহমদ, মো. খলিলুর রহমান খলিল, মো. মাশরেকুল আযম রবি, ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান খান, সেলিম উদ্দিন, মেজর (অব.) আব্দুস সালাম, নিগার সুলতানা রানী, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, শেখ মো. আলমগীর হোসেন, আহমেদ শফি রুবেল, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, সালাহউদ্দিন আহমেদ মুক্তি, লুৎফর রেজা খোকন, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, ফখরুল আহসান শাহজাদা, মো. বেলাল হোসেন, মো. আমির হোসেন ভূঁইয়া, সালাউদ্দিন খোকা মোল্লা, সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন মঞ্জু, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মো. হেলাল উদ্দিন, মো. সাইফুল ইসলাম ও লিয়াকত হোসেন চাকলাদার।
Leave a Reply