আজ ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কারাবন্দি আসামির ভিডিও বক্তব্য ফাঁস,ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ‘কিলিং মিশন’

(আজকের দিনকাল):অবশেষে ফাঁস হলো টাঙ্গাইলের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম তালুকদার নিক্সন খুনের পরিকল্পনা। এটি চূড়ান্ত করতে নিজ বাসায় খুনি চক্রের সঙ্গে বৈঠক করেন আলোচিত দুই সহোদর-সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির ও গোলাম কিবরিয়া বড় মনি। বৈঠকে নিক্সনকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় আজিজ ইঞ্জিনিয়ার ও স্থানীয় যুবলীগ কর্মী সুমনকে। হত্যাকাণ্ডের জন্য বড় মনি তাদের দুই দিনের সময় বেঁধে দেন।

সুমন দুই সহোদরের নির্দেশনা তামিলে রাজি না হলে মোবাইলে কল করে বাসার নিচে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডেকে পাঠান ছোট মনির। তিনি সুমনকে জানালা দিয়ে নিচে দেখতে বলেন। সুমন নিচে তাকিয়ে দেখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে কয়েকজন সদস্য গাড়িতে বসে আছেন। আর কয়েকজন বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করছেন। ছোট মনি তাদের দেখিয়ে সুমনকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘নিক্সনকে হত্যা করতে না পারলে তোদেরই ক্রসফায়ার দেওয়া হবে।’

প্রাণভয়ে খুনের মিশনে যোগ দিতে রাজি হওয়ার পর আজিজ ইঞ্জিনিয়ারের হাতে তুলে দেওয়া হয় টাকার বান্ডিল। সেখান থেকে কিছু টাকা সুমনের হাতেও তুলে দেন। নিক্সন হত্যা মামলার কারাবন্দি প্রধান আসামি সুমনের ভিডিও বক্তব্য থেকে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এই ভিডিও বক্তব্যের কপি এসেছে দৈনিকের কাছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই খুন হন গোপালপুরের হাদিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম তালুকদার নিক্সন। তিনি সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের নির্বাচনি এলাকার বাসিন্দা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

শুরু থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে টাঙ্গাইলের আলোচিত দুই সহোদর ছোট মনির ও বড় মনি জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। মামলার আসামি সুমন আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে দুই সহোদরের নির্দেশে খুন করার কথা স্বীকারও করেছে। এরপরও প্রভাবশালীদের তদবিরে থানা ও ডিবি পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে দুই সহোদরের নাম নেই। বাদী এই চার্জশিট প্রত্যাখ্যান করায় বর্তমানে মামলাটির অধিকতর তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

এ অবস্থায় গত চার জুন টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে হাজিরা দিতে গেলে আদালতের গারদখানায় গোপনে সুমনের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস করা হয়। তাতে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও কারা কীভাবে অংশ নেয় তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে টাঙ্গাইলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বড় মনি কিশোরী ধর্ষণকাণ্ডে ফেঁসে কারাবন্দি হওয়ার পর দুই সহোদরের অপকর্মের নানা স্পর্শকাতর তথ্য বের হয়ে আসছে।

মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট তথ্য থাকার পরও তদন্তকারী সংস্থা তাদের চার্জশিটে আসামি করেনি। টাঙ্গাইল নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ-সদস্য ছোট মনির। তার বাসায় বসেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়েছে বলে এখন জানতে পারছি। আসামি নিজেই তা স্বীকার করেছে। সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়া আসামির এই বক্তব্য আইনি প্রক্রিয়ায় রেকর্ড করলেই জড়িতদের শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব। কিন্তু তদন্ত সংস্থা সেই উদ্যোগও নিচ্ছে না।

জানতে চাইলে টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ-সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির  বলেন, ‘সামনে নির্বাচন তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। সুমনের ভিডিও বক্তব্য আমি দেখেছি। সুমন মাদকাসক্ত ও মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন। জেলখানায় তাকে টাকা দিয়ে ভালো খাইয়ে-পরিয়ে এই বক্তব্য রেকর্ড করে ছাড়া হয়েছে। এটা আরেক জজ মিয়া নাটক।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই মামলার তদন্তের বিষয়ে আমি কখনো কোনো খোঁজখবর নেইনি। নিহত নিক্সন ও আওয়ামী লীগ নেতা রাজ্জাক ভাই মামাতো-ফুপাতো ভাই। মামলার শুরু থেকে তদন্তের বিষয়ে রাজ্জাক ভাই খোঁজখবর রেখেছেন। সুষ্ঠু তদন্তের পর মামলার চার্জশিট হয়েছে। ওর (নিক্সন) বউকে আমরা চেয়ারম্যান বানিয়েছি। আমরা একসঙ্গে চলছি। আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’ সুমন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে প্রায় একই ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়ে আপনাকে নিক্সন হত্যার পরিকল্পনাকারী বলেছে-এ বিষয়ে কী বলবেন, ‘এটা আমার জানা নেই। কারাগার থেকে যে ভিডিও বেরিয়েছে সেটিই আমি দেখেছি।’

ফাঁস হওয়া ভিডিও বক্তব্যে সুমন বলেছেন, ‘তানভীর হাসান ছোট মনির একদিন আজিজ ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন দিয়ে আমাদের তার আদালতপাড়ার বাসায় আসতে বলেন। আমরা বাসায় গেলে ছোট মনিরের পিএস মাসুদ আমাদের রিভিস করে বাসার দোতলায় নিয়ে বসায়।

সেখানে ছোট মনি আমাকে গালাগাল দিয়ে বলে, তোরে যে কইছি তুই নিক্সনকে মাইরা তারপর আমার বাসায় আসবি। আমি তখন দাঁড়িয়ে বলি, লিডার আমি মাফ চাই। নিক্সন আওয়ামী লীগ করে। আমিও আওয়ামী লীগ করি। আমি এ কাজ করতে পারব না। তখন ছোট মনি ইঞ্জিনিয়ার আজিজকেও গালাগাল দিয়ে বলে তোরাই নিক্সনকে মারবি।

রাজনীতিতে নিক্সন আমার সামনে কাঁটা হয়ে দাড়াইছে। ওরে রাখা যাবে না। নিক্সনের কারণে আমি তোগো এলাকায় যাইতে পারি না। আমি আবার হাতজোড় করে মাফ চেয়ে বলি, আমি এ কাজ করতে পারুম না। এরপর এমপি ছোট মনির বলেন, নিক্সনকে মারবি না হলে তোগোরে ক্রসফায়ার দিমু। এ কথা বলেই এমপি তার পিএস মাসুদকে মোবাইল আনতে বলে।

মাসুদ মোবাইল দিলে এমপি ফোনে কথা বলার কিছুক্ষণ পর বলে নিচে তাকাইয়া দেখ। তোরা নিক্সনকে মারবি, না হলে তোগোরে ক্রসফায়ারে মাইরা ফালামু। এমপি সাব যখন এই কথা বলে তখন আজিজ ইঞ্জিনিয়ার নিক্সনকে মাইরা ফালানোর কথা স্বীকার করে।

আমিও মনে মনে ভাবলাম স্বীকার করে যাই। আমিও স্বীকার করি। তখন বড় মনি এসে বলে এই হারামজাদারা আমার ভাই তোদের কি কইছে। সামনে ঈদ তাড়াতাড়ি ওরে মাইরা ফালাবি। ওরে জানি আমি ঈদের পর আর দেহি না। আমরা সাত দিনের সময় চাইলাম। বড় মনি দুই দিন সময় দিল। আমরা চইলা আসার সময় ছোট মনির পিএস ভেতর থেকে একটা টাকার বান্ডিল এনে ইঞ্জিনিয়ারের সামনে রাখে।

এমপি ছোট মনি ইঞ্জিনিয়ারকে বলে, সবাইকে কিছু কিছু দে। আর সব টাকা তোর কাছে রাখ। কাজ শেষে তোরা টাকা নিবি। লাগলে আরও দিমু। আর কাজ শেষে এসএমএস দিয়া জানাবি। যে আগে এসএমএস দিতে পারবি তারে বড় ধরনের পুরস্কার দেওয়া হবে। পরদিনই ইঞ্জিনিয়ার লোকজন সেট করল। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে স্পেশাল দুজন লোক নিয়ে এলো। এমপি ছোট মনি আদালতপাড়া থেকে দুজন লোক দিল।

স্পেশাল এই চারজন হেলমেট পরে দুইটা গাড়ি নিয়ে গেল। আমি, সুমন, ফারুক, সবুজ, হাফিজুর, কামরুলও ছিলাম। হত্যাকাণ্ডের পর এমপি সাহেবের কথামতো আমি তাকে এসএমএস দিয়েছিলাম। আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও এসব কথা বলেছি। ম্যাজিস্ট্রেট কতটুকু লিখছে তা আমি জানি না। আমি এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাব-ইন্সপেক্টর আলমগীর কবির  বলেন, ‘আসামি সুমনের ভিডিও বক্তব্য আমার নজরে এসেছে। তার এই বক্তব্য তদন্তে আমলে নেওয়া হবে। তার আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দির সঙ্গে এই বক্তব্য মিলিয়ে দেখা হবে। বিশেষ করে মামলার বাদী পূর্বের চার্জশিটের ব্যাপারে যেসব আপত্তি দিয়েছে সেগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

কারাবন্দি আসামির এই ভিডিও বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, অপরাধ বিশেষজ্ঞ খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতে একাধিক মামলায় বলা আছে, কোনো আসামি যদি দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় তাহলে সেটার ভিত্তিতেই আসামিদের শাস্তি হতে পারে।

যদি আসামির জবানবন্দি এড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা বা জড়িত কাউকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয় তাহলে তদন্ত সংস্থার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। ২০২২ সালে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট সংশোধন করা হয়েছে।

এখানে আসামির ভিডিও বক্তব্য সিরিয়াস টাইপ অব অ্যাভিডেন্স হিসাবে গণ্য হবে। চার্জশিটে এগুলো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আদালত চাইলে নিজ উদ্যোগে আসামির এই বক্তব্যের রেকর্ড তলব করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্দেশনা দিতে পারে।-যুগান্তর

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ