(আজকের দিনকাল):নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির গতি লাগামহীন হয়ে পড়ছে। এতে ৬ শতাংশের ঘরে মূল্যস্ফীতি নামানোর পরিকল্পনা খুব বেশি কার্যকর হবে না। পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয়ের চ্যালেঞ্জে আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রাও কাগজপত্রেই আটকে আছে। প্রকৃত অর্থে তা অর্জন খুবই কঠিন। কারণ, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করবেন। এ সময় বিনিয়োগ কম হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে জ্বালানি তেল, সার ও ভর্তুকি খাতের খরচ। এ কারণে বিনিয়োগে নেতিবাচক ও বাড়তি ব্যয়ের আঘাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন হবে দুঃসাধ্য প্রত্যাশা।
এসব শঙ্কা ও ঝুঁকি মাথায় নিয়েই শনিবার পহেলা জুলাই শুরু হচ্ছে নতুন (২০২৩-২৪) অর্থবছর। এর মধ্য দিয়ে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হবে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি সরকারের একটি বৈঠকে চলমান সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী বৈশ্বিক পরিস্থিতি নজর রেখে সতর্কতার সঙ্গে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সরকারি ব্যয়ের সব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক ও দ্রুত রিটার্ন আসবে-এমন বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন।
নতুন অর্থবছর প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগামী বছর কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটি অর্জনযোগ্য না। এছাড়া জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে, সেটিও অর্জনযোগ্য নয়। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘরে রাখা কঠিন হবে। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিস্থিতি সন্তোষজনক না। যদিও সম্প্রতি কিছু বেড়েছে কুরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে আসা রেমিট্যান্সের জন্য। এছাড়া রয়েছে মুদ্রা বিনিময় হার। এই চ্যালেঞ্জগুলো আগামী অর্থবছরে থাকবে।
শুক্রবার শেষ হবে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর। পরের দিন শনিবার শুরু হচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধে অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির মতো সংকটগুলো নতুন অর্থবছরে চাপ সৃষ্টি করতে পারে-এমনটি আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
তবে সবচেয়ে বেশি সংকট সৃষ্টি করবে পণ্যমূল্য। ইতোমধ্যে পণ্যমূল্য জাতীয় অর্থনীতিতে একধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে-এমনটি আভাস দিয়েছে অর্থ বিভাগ। কারণ, পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এটি মোকাবিলায় গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গতিশীল করতে সরকারের দায় বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরে শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে-এমন কোনো আভাস নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এটি প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। ফলে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনা প্রায় অনিশ্চিত অনেকটা।
বিনিয়োগ নিয়ে খুব বেশি আশার আলো দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই বিনিয়োগ ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, বেসরকারি বিনিয়োগে অতিরিক্ত ৪ লাখ ৪ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বা ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি প্রয়োজন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মাঝামাঝিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সাধারণত নির্বাচনি বছরে বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করেন। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি জানান, এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি অনেক। বেসরকারি বিনিয়োগ কমছে। সব মিলে আগামী অর্থবছর চ্যালেঞ্জিং হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া বৈশ্বিক পেক্ষাপট শিগগিরই বেশি উন্নতি হবে বলা যায় না। প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থার উন্নতি হলেই কেবল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। এক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে সামনে জাতীয় নির্বাচন আছে। ওই সময় বিনিয়োগকারীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’-এ নীতি গ্রহণ করেন। ফলে বিনিয়োগকারীরা এ সময় এগিয়ে আসবেন, তা বলা যায় না।
নতুন অর্থবছরে বেশকিছু উদ্যোগ চালু হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, যা প্রণোদনা হিসাবে দেওয়া হবে। অর্থ বিভাগের হিসাবে এজন্য ৪ হাজার কোটি টাকা বছরে ব্যয় হবে। এছাড়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হচ্ছে পহেলা জুলাই থেকে। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে রুপিতেও বাণিজ্য শুরু হবে নতুন অর্থবছরে। এছাড়া ব্যাংকগুলোয় সুদহারে করিডর ব্যবস্থা চালু হবে পহেলা জুলাই থেকে। এতে ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়বে।
ডলার সংকট একটি বড় সমস্যা। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে এখনো পৌঁছেনি। আগামী অর্থবছরে মুদ্রা বিনিময় হার ছেড়ে দেওয়া হবে বাজারের ওপর। ফলে ডলারের মূল্য নির্ধারণ হবে বাজারভিত্তিক। ধারণা করা হচ্ছে, এতে ডলারের মূল্য কিছুটা বাড়তে পারে। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে পণ্যমূল্যের ওপর। এসব ঝুঁকি শেষ পর্যন্ত আর্থিক ব্যবস্থাকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
জানা যায়, নতুন অর্থবছরে সরকার ঋণের পরিবর্তে যে সুদ পরিশোধ করবে, এটি মোট আর্থিক ব্যয়ের বড় একটি অংশ। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ খাতে সরকারকে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হবে।-যুগান্তর
Leave a Reply