(আজকের দিনকাল):জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ততই বাড়ছে। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশা, স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব বলয় তৈরিসহ নানা কারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে সফর বৃদ্ধি, ঢাকায় ডেকে মীমাংসা করাসহ নানা উদ্যোগ থাকলেও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। দলের অব্যাহত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীনরা। এমতাবস্থায় নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ ঐক্য আরও সুদৃঢ় করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের সংসদ-সদস্য ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে মনোনয়নবঞ্চিত করাসহ দলীয় পদও হারাতে হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করেছেন তিনি। এছাড়া দলের বিভিন্ন পর্যায়ে ত্যাগীদের সামনে আনার বিষয়ে সভায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলীয় প্রধানের সঙ্গে তৃণমূলে নেতাদের বিশেষ বর্ধিত সভার ফলে কোন্দল অনেকটা কমে আসবে। বিশেষ করে দলীয় প্রধানের কঠোর নির্দেশনা তৃণমূলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটাও খুবই গুরুত্বপর্ণ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধানের এ বার্তা তৃণমূলে দলের নেতা ও দলীয় এমপি বা জনপ্রতিনিধিদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করবে বলেও মনে করছেন নেতারা। এদিকে দলীয় প্রধানের নির্দেশনার পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নামতে পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, আমাদের সভানেত্রী (শেখ হাসিনা) দলের ঐক্যের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলোতে দলের ত্যাগী ও দুর্দিনের কর্মীরা যেন বাদ না পড়েন সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিএনপির সময় যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি এবং জনগণের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, সেগুলো তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত মানুষের কাছে গিয়ে বলতে হবে। এছাড়া আমাদের সরকারের সময়ে যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে তুলে ধরতে হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলের নেতা-এমপিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার-বিষোদগার বন্ধ করতে হবে। নেত্রী সবাইকে সহনশীল হওয়ার জন্য বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উপরে থুতু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে।’ এটা বন্ধ করতে হবে। যাতে করে কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়। মনোনয়ন নিয়ে নীতি কি হবে সেটিও তিনি পরিষ্কার করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেরা যদি নিজেদের গুছিয়ে চলতে পারি, নিজেরা যদি নিজেদের মধ্যে বিভ্রান্তি না ছড়াই, আমাদের যারা প্রতিপক্ষ তারা জনপ্রিয়তার দৌড়ে আমাদের ধারেকাছেও নেই।
একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সব সময়ই দলের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি সময় সময় তৃণমূলের দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের কথা বলেন। বিশেষ করে যারা পঁচাত্তরের পরে দলের জন্য কাজ করেছেন, নেত্রী দেশে আসার পরে যারা নেত্রীর সঙ্গে ছিলেন, ২০০১-০৮ এই দুঃসময়ে যারা রাজপথে ছিলেন তাদের মূল্যায়ন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া দলের অভ্যন্তরীণ কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধের নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নেত্রী বলেছেন, কোনো সমস্যা থাকলে নিজেরা বসে তা সমাধান করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে সারা দেশের বেশিরভাগ নির্বাচনি আসনেই দলীয় সংসদ-সদস্য এবং জেলা-উপজেলার নেতা এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরোধ তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গাতেই মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এমপিদের সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। স্থানীয় নেতা বা দলের জনপ্রতিনিধি যারা নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চান তাদের অনেক এলাকাতেই এমপিদের বিরুদ্ধে একজোটও হতে দেখা গেছে। আবার এমপিরাও নিজেদের মতো করে তৈরি করেছেন আলাদা বলয়। এসব বিষয়ে পালটাপালটি অভিযোগের পাহাড় কেন্দ্রেও জমা হয়েছে। এতে সুযোগ পাচ্ছে বিরোধীরা। দিন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের সমালোচনা করতে গিয়ে দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলা হচ্ছে।
এদিকে এমপিদের ঘিরে এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও অসন্তোষের তথ্য উঠে এসেছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছেও। ৬ আগস্ট তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে টানা কয়েক ঘণ্টা বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের বিশেষ বর্ধিত সভায় সারা দেশ থেকে তিন হাজারের বেশি তৃণমূল নেতা ওই সভায় যোগ দেন। সেখানে তৃণমূল নেতাদের কথা মনোযোগ দেন শোনেন দলীয় প্রধান। তারা নিজেদের দাবি এবং অভিযোগ বিষয়ে সভাপতিকে অবগত করেন। কিছু কিছু এলাকায় এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের মাত্রায় রীতিমত উদ্বিগ্ন শীর্ষ নেতারা। এরই পেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বিভেদ ভুলে টানা চতুর্থবারের মতো দলকে ক্ষমতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন। দল যাকেই মনোনয়ন দেবে আগামী নির্বাচনে তাকে বিজয়ী করতে বলেছেন।
এরপর শনিবার দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ডাকে আওয়ামী লীগ। ওই সভাতেও উঠে আসে অভ্যন্তরীণ সমস্যার বিষয়গুলো। সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, আপনি অনেকবার বলার পরও দলের নেতারা এমপিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছে। এটা যেন আর না হয় এজন্য আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সভায় দলের সংসদ-সদস্য বা নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার করা থেকে বিরত থাকতে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, যারা দলীয় এমপি, দলীয় প্রার্থী বা নেতার বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের তো মনোনয়ন দেবই না, সামনে দলের কোন পদ-পদবিতে রাখব কিনা সেটাও ভাবতে হবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো বন্ধে আমরা অবশ্যই গুরুত্ব দিচ্ছি। পরিকল্পনা মতে, খুব শিগগিরই এই ধরনের বিষয়গুলোতে দোষীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এই এগুলো নির্মূল করতে চেষ্টা করছি এবং করব। ইনশাআল্লাহ এটা করতে পারব। তিনি আরও বলেন, অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিড তো আছেই। অনেক ক্ষেত্রে এরা দায়ী এটাও ঠিক। এগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। এছাড়া চাওয়া, না পাওয়া ও স্বার্থের কিছু দ্বন্দ্ব আছে। আমরা সব বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়ে নিরসনের চেষ্টা করছি।
Leave a Reply