(আজকের দিনকাল):সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে টানা কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে আছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের সফলতা চায় দলটি। এজন্য দ্বন্দ্ব-বিভাজন মিটিয়ে দলকে আরও শক্তিশালী করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কৃত দুই শতাধিক নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা ভুল স্বীকার করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন। এছাড়া চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্য পদগুলোও পূরণ করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজন সক্রিয় নেতাকে সম্প্রতি পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিএনপি থেকে বহিষ্কৃতদের মধ্যে অধিকাংশই সিটি করপেরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে অংশ নিয়েছিলেন। দায়িত্বশীল নেতারা জানান, সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। আবার জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রও থেমে নেই। এমন পরিস্থিতিতে বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য সিনিয়র নেতারা হাইকমান্ডকে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ প্রত্যাহার করা না হলে এসব নেতা সক্রিয় হতে পারছেন না। বহিষ্কৃত অনেক নেতা আছেন, যারা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী, তাদের দলে ফিরিয়ে আনা হলে আন্দোলন আরও গতিশীল হবে।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যানসহ নির্বাহী কমিটির অর্ধশতাধিক পদ শূন্য রয়েছে। তা পূরণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে কোষাধ্যক্ষ পদে পদোন্নতিসহ বেশ কয়েকজনকে শূন্যপদে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির পদ নানা কারণে শূন্য হয়েছে। কেউ মারা গেছেন। সেখানে সক্রিয় নেতাদের মধ্য থেকে পদ পূরণ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত পাননি বলে জানান তিনি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বহিষ্কৃত অনেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেছেন। তাদের দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও একমত। যা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার শুরু হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরা মনে করি যারা পরীক্ষিত, আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো ভুল করেছে, তারা যদি এখন সংশোধিত হয়ে আসে এতে করে দলের শক্তি ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়। এজন্য তাদের আগ্রহের ভিত্তিতে দলেরও অগ্রসর হওয়া উচিত।
এর আগে ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও বহিষ্কৃত শতাধিক নেতাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। সে সময় ১০ বছরে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা-মহানগরের যেসব নেতাকে বহিষ্কার করা হয়, তাদের একটি খসড়া তালিকাও তৈরি করা হয়। সে তালিকায় স্থান পেয়েছিল প্রায় চারশ নেতার নাম। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় দুইশ নেতার নাম লল্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজনকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়।
নেতারা জানান, বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে টানা সমাবেশ ও রোডমার্চ কর্মসূচি চলবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত। দাবি আদায়ে কর্মসূচি সফলে মহানগরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়া শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নেতা স্থানীয় পর্যায়ে অনেক জনপ্রিয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে ছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাদের। মামলায়ও জর্জরিত। এসব নেতাকে দলে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্থানীয় নেতারাও কেন্দ্রকে চাপ দিচ্ছেন। কারণ এবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও কয়েকজনকে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি, কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুসহ কয়েকজনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। তারাও স্থানীয় রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী নেতা।
দল থেকে অব্যাহতির পরও নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনায় সমাবেশসহ বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে অংশ নিচ্ছেন। মঞ্জু বলেন, দলে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত চারবার আবেদন করেছি। কেন্দ্র থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমি শহিদ জিয়ার আদর্শে ও খালেদা জিয়ার স্নেহে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতির ৪৫ বছরের শত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন বিশ্বস্ত নেতা হিসাবে বিএনপি ছেড়ে অন্য কোনো দলে যোগদানের প্রশ্নই আসে না। বিএনপিই আমার ঠিকানা। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসা, তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীতে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করতে রাজপথের কর্মী হিসাবে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি।’
এদিকে ২০১৬ সালের মার্চে বিএনপির ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়। সেখানে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব নির্বাচিত হন। এরপর দলটির সম্মেলন হয়নি। ওই কাউন্সিলে ১৯ জনের স্থায়ী কমিটির ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে আরও দুজনকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। এর মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, আসম হান্নান শাহ ও এমকে আনোয়ার মারা গেছেন। অসুস্থতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও মাহবুবুর রহমান। সালাহ উদ্দিন আহমেদ ভারতে রয়েছেন। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও বিদেশে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় স্থায়ী কমিটির শূন্য চারটি পদ পূরণেরও গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া ৭৩ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির বেগম সরোয়ারি রহমান, হারুনার রশিদ খান মুন্নু, ফজলুর রহমান পটলসহ ৫ জন মারা গেছেন। ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে কমিটি ঘোষণার পরপরই পদত্যাগ করেন মোসাদ্দেক আলী ফালু। ইনাম আহমেদ চৌধুরী দলত্যাগ করেন। মারা গেছেন ৬ জন। নির্বাহী কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকটি পদ আগে থেকেই ফাঁকা, আবার কয়েকজন মারা গেছেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন দশ জন। এসব শূন্য পদে নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে এসব পদে সক্রিয়দের দেওয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।-ডেস্ক
Leave a Reply