(আজকের দিনকাল):আলোচিত বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে ২০১০ সালে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানের তথ্য মতে, ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে এই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে আত্মসাতের পরিমাণ আরও বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। এত বড় ঋণ কেলেঙ্কারির পর পার হয়েছে প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু এ ঘটনার মূল হোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। উচ্চ আদালত থেকে বারবার নির্দেশনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করার পর গত জুনে আলোচিত এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের হওয়া ৫৯ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। এর ৫৮টিতেই অভিযুক্ত হয়েছেন আব্দুল হাই বাচ্চু।
এরপর গত ৩ অক্টোবর বাচ্চু ও তার স্ত্রী-সন্তান, ভাইসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নতুন মামলা করে দুদক। দুদকের ৫৯টি মামলার এই আসামি দুই দফায় হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন; কিন্তু নিজে আদালতে হাজির হননি। এমনকি তাকে গ্রেপ্তারে দুদকেরও কোনো পদক্ষেপ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক শুরু থেকেই আব্দুল হাই বাচ্চুর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছে। এজন্য আমলযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর চার্জশিট দাখিলের পরও তার প্রতি সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে।
আইন অনুযায়ী এক বছরের মতো লাগার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্র যেন সম্পূর্ণ আলাদা। বছরের পর বছর এমনকি যুগ পেরিয়ে গেছে বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির তদন্ত শেষ করতে। আর বিচার শেষ করতে কত বছর লাগবে—এখন সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
জানতে চাওয়া হলে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ বর্তমানে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, ‘এর আগে তিনটি কমিশন গেছে; কিন্তু এত বড় লুটপাটের ঘটনায় তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গণমাধ্যমেরও জোরালো ভূমিকা দেখিনি। এই কমিশন অভিযোগপত্র দিয়েছে। এখন আব্দুল হাই বাচ্চুকে গ্রেপ্তারের জন্য আইনানুগভাবে যা যা করার, তা করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইনে নির্ধারিত সময়সীমা কোনো দিনই মানা হয়নি। এখন আমরা বিলম্ব হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শোকজ করছি। বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
শেখ আব্দুল হাই বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার আডুয়াডিহি গ্রামের পুলিশের প্রয়াত উপপরিদর্শক শেখ আবদুল হামিদের ছেলে। বাগেরহাটের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন সামান্য একজন যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী। পরে এরশাদের সময়ে হন জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আব্দুল হাই বাচ্চু। আর তখনই ব্যাংকটির দিলকুশা, গুলশান ও শান্তিনগর শাখার কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এর আগেই ২০১০ সাল থেকে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এই ঘটনায় ৫৯টি মামলা করে দুদক। কিন্তু কোনো মামলায় আসামি হিসেবে বাচ্চুর নাম ছিল না। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় নানা মহলে। হাইকোর্টও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে মামলা দায়েরের দুই বছর পর ২০১৭ সালে তাকে পাঁচ দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিশন। প্রায় আট বছর তদন্ত শেষে বাচ্চুসহ ১৪৭ জনকে আসামি করে গত ১২ জুন আদালতে ৫৯টি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় আছেন ব্যাংকের ৪৬ কর্মকর্তা এবং ১০১ জন ঋণগ্রহীতা। এর মধ্যে ৫৮টি মামলায় আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়েছে।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আগাম জামিনের আবেদন করেছে কি না—এটা দুদকের বিবেচ্য বিষয় নয়। তাকে কোনো আদালতই জামিন দেননি। সে একজন পলাতক আসামি। তাকে গ্রেপ্তারে আদালতের পরোয়ানাই বা লাগবে কেন? গ্রেপ্তারে আদালতের ওয়ারেন্ট লাগবে—এটা তো বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো হয়ে গেল।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি আমলযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে যে কোনো সময় আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়। আব্দুল হাইয়ের ক্ষেত্রে দুদক শুরু থেকেই সহানুভূতি দেখিয়ে আসছে। প্রথমত সহানুভূতি দেখিয়েছে, তাকে মামলায় আসামি না করে। পরে হাইকোর্ট মূল হোতাকে আসামি না করায় বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করার পর চার্জশিটে তার নাম এসেছে। তদন্তকালেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এখন চার্জশিট দেওয়ার পরও সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে। দুদক এটা করতে পারে না।’-কালবেলা
Leave a Reply