ইসি সূত্রমতে, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের আগেই ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে উন্নতমানের ইভিএম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কে এম নূরুল হুদা। প্রাথমিকভাবে ৮০ হাজার ইভিএম কেনে ইসি। ঐ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও পিছু হটেনি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। এজন্য নেওয়া হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সিদ্ধান্ত হয় ২ লাখ ২০ হাজার ইভিএম কেনার। বিগত কমিশনের পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। ঐ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো, যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের চেয়ে দাম কয়েকগুণ বেশি। তীব্র বিরোধিতার মুখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পে কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। চলতি বছরের জুনে শেষ হচ্ছে প্রকল্প মেয়াদ, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে চিঠি দিচ্ছে ইসি।
ইভিএম মেশিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হয়। বিদ্যমান স্টোররুমে এই ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে ইভিএমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার কথা জানিয়েছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। এজন্য নতুন করে গ্রহণ করা হয় ৯ হাজার কোটি টাকার দ্বিতীয় ইভিএম প্রকল্প। কিন্তু সরকারের আর্থিক সংকটের কারণে সেই প্রকল্প স্থগিত করা হয়। আর ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালটেই দ্বাদশ সংসদ ভোট হয়। এতে করে বিদ্যমান ইভিএমের প্রতি মনোযোগ হারায় কমিশন।
প্রথম দিকে ইভিএমগুলো আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে রাখা হতো। কিন্তু সমস্যা হয় নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ে মেশিন পাঠানো নিয়ে। কেননা, এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোতে ইভিএম রাখার। কিন্তু কোনো মাঠ কার্যালয়ে ইভিএম রাখার মতো পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। এছাড়া ইভিএম রাখার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তাও ছিল না। ২০২২ সালের শেষের দিকে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ইভিএম মেশিন উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করছে বলে খোদ ইসি কর্মকর্তারাই বৈঠকে জানিয়েছিলেন। ইভিএম উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করেছে—এমন অভিযোগে সরেজমিনে তদন্ত করে কমিশন। তদন্ত রিপোর্টে ইভিএম সরঞ্জামের জন্য ব্যবহৃত বেশ কিছু কাগজের প্যাকেট এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রীর কিছু তার নষ্ট হয়েছে বলে উঠে আসে। এরপর স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা ৮৫ হাজার ইভিএম বর্তমানে মাঠ অফিস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রগুলোতে রাখা হয়। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে। মাঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তাগাদা দিচ্ছে মেশিনগুলো সরিয়ে নিতে। কিন্তু তাদের এসব মেশিন রাখার জায়গা নেই। এ অবস্থায় প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোর পরিধি বাড়ানোর। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে আঞ্চলিক, জেলা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোর যে নকশা, তাতে এগুলো ওপরের দিকে আর বাড়ানো যাবে না। এরপর সিদ্ধান্ত হয় ভবন ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তেও কোনো কূল-কিনারা মিলছে না। কেননা, ইভিএম রাখার জন্য প্রতি উপজেলায় পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিমাণ জায়গা একই ভবনে মেলে না। আর মিললেও নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো নয় বা ভাড়া পাওয়া যায় না। আর ভাড়া পাওয়া গেলেও দেখা যায় তা বাজেটের চেয়ে বেশি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, বরাদ্দ না পেলে নষ্ট ইভিএম দিয়ে তো কিছু করার নেই। এ ছাড়া ভবিষ্যতে নতুন করে ইভিএম কেনা নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই ইসির।
২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রচলন শুরু করে বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। সে সময় তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা করে প্রায় সাড়ে বারো শ ইভিএম তৈরি করিয়ে নেয়।-ইত্তেফাক
Leave a Reply