আজ ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কমপ্লিট শাটডাউন, কোথায় যাচ্ছে দেশ

গোলাম মাওলা রনি,(আজকের দিনকাল):প্রতি মুহূর্তে নিত্যনতুন ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রায় সব ঘটনাই আমরা টের পাচ্ছি ঘটে যাওয়ার পর। প্রতিটি ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা যাই ঘটছে, তার বেশির ভাগ ঘটছে আমাদের মন-মস্তিষ্কজাত সহজাত বুদ্ধি কিংবা কল্পনা অথবা আশা-আকাক্সক্ষা অথবা আতঙ্কের সীমার বাইরে। ১৮ জুলাই ২০২৪ সালের রাত ৮টা পর্যন্ত আমরা কল্পনা করতে পারিনি যে, পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে এবং তা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলতে থাকবে। দেশে হানাহানি হবে, শত শত নির্মম নিষ্ঠুর খুনখারাবি ও হত্যাকাণ্ডের সাথে পাল্লা দিয়ে লাখ লাখ মানুষের শরীর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হবে। বেশুমার লোক আহত হয়ে জুলাই ম্যাসাকার নামক একটি অধ্যায়ের অংশীদার হবে।

আমরা বুঝতে পারছি না আগামীকাল কী ঘটতে যাচ্ছে; যেভাবে আমরা বুঝতে পারিনি আজকের শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দমালার অর্থ। আমাদের সন্তানরা যখন ন্যায্যতার ভিত্তিতে কোটা- এ শব্দমালা নিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইল, তখন আমাদের অথর্ব মস্তিষ্ক এবং অহমিকায় পরিপূর্ণ মন বুঝতে পারল না যে, আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে। ফলে রাজপথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন একের পর এক বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রদর্শন করতে থাকলেন তার বিপরীতে আমাদের অনেকের ক্রোধ, নির্বুদ্ধিতা ও অশিক্ষা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল। আমরা ছাত্রছাত্রীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে গিয়ে কিভাবে যে কমপ্লিট শাটডাউনের কবলে পড়লাম তা বুঝতে পারলাম না।

আমি যখন আজকের নিবন্ধ লিখছি তখন সারা দেশ উত্তাল। ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই বুধবার বিকেলে যখন এ নিবন্ধ লিখছি তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামক দেশের পুরনো রাজনৈতিক দলটিকে সরকারি নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করতে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবক, শিক্ষক এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে দেশের সব বিচার অঙ্গনে সমাবেশ করছে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নাম দিয়ে। অর্থাৎ বিচারালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তারা ন্যায়বিচারের দাবিতে যে বিক্ষোভ করছেন তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গর্র্দভরা না বুঝলেও দুনিয়ার জ্ঞানী-গুণীরা কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন এবং দশমুখে ছি ছি শুরু করেছেন।

কমপ্লিট শাটডাউনের অর্থ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যেমন আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি; তেমনিভাবে মার্চ ফর জাস্টিসের ওজনও আন্দাজ করা যায়নি।
আমরা আন্দাজ করতে পারিনি কমপ্লিট শাটডাউনের ডালপালা গজিয়ে রেমিট্যান্স শাটডাউনে রূপ নেবে। প্রবাসে অবস্থানরত প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশীর মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়বে। আমরা বুঝতে পারিনি, মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের মূল্য এক লাফে ডলারপ্রতি আট-নয় টাকা বেড়ে যাবে। রেমিট্যান্স শাটডাউনের প্রভাবে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দেবেন এমনটি আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

আমি নিজে হাল আমলে বোধ-বুদ্ধির দুর্ভিক্ষে পড়েছি। আমার বয়স এখনো ষাট বছর অতিক্রম করেনি। অথচ এ বয়সে আমি বুদ্ধিশুদ্ধি-কৌশল ও সাহসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে পেরে উঠছি না। আমার কাব্য প্রতিভা, সাহিত্যিক মননশীলতা এবং জ্ঞান-গরিমা একত্র করে গত দুই সপ্তাহ ধরে হামানদিস্তার মধ্যে ভরে কমপ্লিট শাটডাউনের বিকল্প একটি শব্দ আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। কিন্তু মাথা থেকে নতুন কিছু বের হচ্ছে না অথচ শিক্ষার্থীরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন স্লোগান আবিষ্কার করে ফেলছে- বিপ্লবী গান রচনা এবং অভিনব সুরে তা সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের বিপ্লবের গানে কণ্ঠ মেলাচ্ছে কলকাতার অসংখ্য মানুষ। কণ্ঠ মেলাচ্ছেন লন্ডন-আমেরিকা-দুবাই-প্যারিস-জেদ্দা থেকে শুরু করে সুদূর আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার বিপুল মানুষ।

শিক্ষার্থীদের বিল্পবের বাণীর কাছে পুলিশের লাঠি, গুলি-টিয়ার শেল ইতোমধ্যে পরাজিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তপনার নিকৃষ্ট কৌশল যথা-
মামলা-হামলা-গুম-খুন-গ্রেফতার-নির্যাতন-রিমান্ড-কারফিউ ইত্যাদি সবকিছু কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। আমার মতো প্রৌঢ়রা যেখানে তারুণ্যের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ধারেকাছে যেতে পারছি না সেখানে ৮০-৯০ বছরের বুড়া-বুড়িরা কী করছেন বা কী করার চেষ্টা করছেন তা অনুধাবনের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের অজান্তে খিলখিলিয়ে হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছি। পরিণত বয়সে আমার এ বালখিল্যের কাহিনীটি আপনাদের বললে আপনারাও না হেসে পারবেন না।
ব্যক্তিগতভাবে আমি আজীবন মোটা মাথার লোক। কোনো কিছু সহজে বুঝি না। কোনো কিছুতে যেমন সন্দেহ হয় না, তদ্রƒপ কোনো বিষয় নিয়ে মাথার মধ্যে অভিনব কোনো প্রশ্নের উদ্রেক হয় না। কতকাল যে কতভাবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকেছি কিংবা নদীর পাড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর কলকল ধ্বনি শুনে দু’লাইন কবিতা রচনার চেষ্টা করেছি তা আপনাদের বুঝাতে পারব না। আমার কাছে সবসময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো মনে হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি কে আমায় ভালোবাসে কিংবা কে আমায় ঘৃণা করে। আমার পশ্চাৎদেশে আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনো দিন বুঝিনি কেউ আমায় আঘাত করতে পারে।

আমার উল্লিখিত বোধবুদ্ধির কারণে গত দুই-তিন দিনের ঘটনা এবং সেসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখে নিজের নিবুর্দ্ধিতায় আমি এতটা অবাক হয়ে গেছি যে, আপন মনে খিলখিলিয়ে না হেসে পারিনি। দেশের ডিবি পুলিশের মহারাজ বলে স্বীকৃত কর্তারা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছয়জন নেতাকে ধরে নিয়ে গেল তখন আমি ভাবলাম- এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা। যেখানে দেশের রথী-মহারথীদের ডিবি ধরে নিয়ে যায় এবং যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচায় সেখানে নবীন নেতারা তো নস্যি। এরপর যখন দেখলাম ছয়জন নেতা নুডলস খাচ্ছেন এবং ভরা পেটে সরকারের পক্ষে আন্দোলন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিচ্ছেন তখন ভাবলাম সব তো ঠিক আছে। পত্রিকায় নেতাদের ছবি বের হলো। একজন লুঙ্গি পরে কোলের ওপর পত্রিকা রেখে লিখিত বিবৃতি পাঠ করছেন এবং বাকিরা তার পাশে সুবোধ বালকের মতো বসে আছেন।

আমি উল্লিখিত ছবি বারবার দেখলাম কিন্তু ছবির মধ্যে কোনো কবিতার সন্ধান পেলাম না, কোনো স্লোগান অথবা বিল্পবের ইঙ্গিতও পেলাম না; বরং মনে হতে লাগল- সব কিছু সরকার নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। ডিবির মহারাজদের বুদ্ধি-কৌশল-শক্তি নিয়ে যখন কবিতা রচনার চিন্তা করতে যাবো ঠিক তখন দেখলাম সারা বাংলার ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভের নতুন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনের আকাশে নতুন কর্মসূচি- মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ এবং লাল রং দিয়ে সামাজিকমাধ্যমে নিজের প্রোফাইলের ছবিতে রক্তের ছবি আঁকার অভিনব কৌশলে আবার নতুন করে কমপ্লিট শাটডাউন দুনিয়া তোলপাড় করে দিলো।

পত্রিকার খবরে জানলাম ডিবির কাছে আটক থাকা কোটা আন্দোলনের ছয় নেতা স্বেচ্ছায় সরকারের পক্ষে বিবৃতি দেননি। তারা অস্ত্রের মুখে বাধ্য হয়ে যে কাজটি করেছেন তা বোঝানোর জন্য একজন নেতা কৌশলে নিজের একটি হাতকে পিস্তল বানিয়ে এবং একটি আঙুল উঁচিয়ে সেই আঙুলটি পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দেয়ার প্রতীক বানিয়ে যেভাবে দেশ জাতির কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন তা আমার মতো গণ্ডমূর্খ না বুঝলেও সারা দেশের ছাত্রসমাজ মুহূর্তের মধ্যে বুঝে যায় এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ অবস্থায় আমি পত্রিকার পাতা খুলে ছবিটি আবার দেখি এবং নবীন নেতার উঁচু করা আঙুলটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। আমার মনে হতে থাকে, যে নেতা তার আঙুল উঁচিয়ে আমার স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে খোঁচা দিচ্ছেন আর বলছেন, ওরে অবোধ ওরে কাঁচা-তাড়াতাড়ি নিজেকে বাঁচা। আমি নেতার খোঁচা খেয়ে তার সতীর্থদের মতো বিদ্রোহের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মতো সারা শরীরে সুড়সুড়ি অনুভব করতে থাকি এবং বেকুবের মতো মনের আনন্দে হেসে গড়াগড়ি দিতে থাকি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
সুত্রঃ নয়াদিগন্ত

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ